মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক
আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীকের বীরত্বগাঁথা)

মুক্তিযুদ্ধে সুবেদার আফতাব আলী ও তার প্রতিষ্ঠিত আফতাব বাহিনী ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আতঙ্কের নাম। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য বীর উত্তম ও বীর প্রতীক- ২টি খেতাবে ভূষিত করা হয় সুবেদার আফতাব আলীকে। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ২৭, বীর প্রতীক খেতাবে তার সনদ নম্বর ৬২।

১৯৭১ সালের শুরুতে আফতাব আলী সুবেদার পদে কর্মরত ছিলেন সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মার্চ মাসে তার কোম্পানি ছিল গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে। ৩১ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বাঙালি অফিসার ও সেনাদের ওপর আক্রমণ চালালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এরপর এপ্রিলের প্রথমার্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির একাংশ বিদ্রোহ করে সুবেদার আফতাব আলীর নেতৃত্বে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থেকে রৌমারীর চরাঞ্চলে অবস্থান নেয়।

১৪ এপ্রিল সুবেদার আফতাব আলীর নেতৃত্বে তার বাহিনী রৌমারী থানা দখল করে। পরে ৬০০ বর্গমাইল এলাকা নিজেদের দখলে এনে রৌমারীকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলে বাহিনীটি। মুক্তিযুদ্ধে এটিই ছিল সীমান্ত সংলগ্ন সবচেয়ে বড় মুক্তাঞ্চল। রৌমারীতে স্থাপন করা হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সেখানে গড়া প্রথম ক্যান্টনমেন্ট এবং সামরিক প্রশিক্ষণ স্কুল থেকে প্রায় ১৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। রৌমারীকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ধরে রাখার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন সুবেদার আফতাব আলী।

সুবেদার আফতাব আলীর আগমনে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ফিরে আসে। পরে আফতাব বাহিনীতে যুক্ত হন স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকরা। এই যুবকদের দিয়েই যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের বিভিন্ন চরে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ৪ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তিমারির সাপ্তাহিক বাজারের দিনে কোদালকাটি চরের দখল নিয়ে নেয়। এরপর ৮ আগস্ট সকাল থেকে কোদালকাটির পাকিস্তানি অবস্থানকে ঘিরে সুবেদার আফতাব আলী কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

সুবেদার আফতাব আলীর দুর্ধর্ষ রণকৌশলের সামনে কিছুতেই রৌমারী দখল নিতে পারেনি পাকিস্তানি বাহিনী। রৌমারী মুক্তাঞ্চলের ওপর ভিত্তি করে এনবিসি টেলিভিশন নির্মাণ করেছিল 'The country mad for disaster' এবং 'Deadline Bangladesh'। রৌমারীকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ধরে না রাখতে পারলে এই ২টি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ সম্ভব হতো না।  এই ২টি প্রামাণ্যচিত্র যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শিত হওয়ার পরে বিশ্বজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছিল।

২১ সেপ্টেম্বর  সুবেদার আফতাবের বাহিনীর রাজিবপুরের প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়েও পিছু হটতে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী। পরে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ৩ দিনে ৫ বার সেনা অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয় হানাদার বাহিনী। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে সুবেদার আফতাবের ১ নম্বর এমএফ কোম্পানিকে কোদালকাটি পুনরুদ্ধার করার দায়িত্ব দেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডার মেজর মোহাম্মাদ জিয়াউদ্দিন। এরপর ১ অক্টোবর প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানিকে দেওয়া হয় ফায়ার কাভারের দায়িত্ব। এদিন রাতে হাবিলদার রেয়াজুল, মনসুর, তাহের ও হাবিলদার মুহিবের নেতৃত্বে ৪টি প্লাটুন নিয়ে নদী পার হয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন আফতাব আলী।

২ অক্টোবর দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী খারুভাঞ্জ থেকে ২ দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর মর্টার হামলা চালায়। দক্ষিণ পাশে হাবিলদার রেয়াজুলের প্লাটুনের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হয় হানাদার বাহিনীর।  এক পর্যায়ে হাবিলদার রেয়াজুলের ১ নম্বর প্লাটুন পিছু হটে। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ধওয়া করে এবং হাবিলদার মনসুরের প্লাটুনকেও আক্রমণ করে। হাবিলদার মনসুরের বাহিনীও পিছু হটলে পাকিস্তানি বাহিনী ধাওয়া করে তাদের। কিন্তু পথে নিজেদের আরেকটি দলকে মুক্তিবাহিনী মনে করে তাদের ওপর গোলাবর্ষণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর ২ পক্ষের এ ভুল বোঝাবুঝিতে তারা নিজেদের গুলিতে নিজেরাই ধরাশায়ী হয়ে যায়। হানাদার সেনা ও রাজাকারসহ প্রায় ১৫০ জন হতাহত হয়।  পাকিস্তানি ক্যাম্প কমান্ডার তখন কোদালকাটি অবস্থান ছেড়ে চিলমারীতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

মুক্তিযুদ্ধে সুবেদার আফতাব আলী বহু পাকিস্তানি চর ও রাজাকারকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। একবার তার ২ পায়ে ৪টি গুলিও লেগেছিল। কিন্তু এরপরও তিনি দমেননি। সুস্থ হয়ে আবারও যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।

আফতাব আলীর জন্ম সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর দক্ষিণভাগ গ্রামে ১৯২৫ সালের ১ ডিসেম্বর।

মুক্তিযুদ্ধের পরে তাকে অনারারি ক্যাপ্টেন পদমর্যাদা দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুবেদার আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস

 

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Is the govt backing the wrongdoers?

BNP acting Chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of a scrap trader in front of Mitford hospital due to what he said its silent support for such incidents of mob violence.

6h ago