নিকন ও ক্যানন যে কারণে ডিএসএলআর ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে

ছবি: এনগেজেট

চলতি বছরের জুলাইয়ে ক্যামেরা ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় খবর হলো, নতুন মডেলের এসএলআর ক্যামেরা তৈরি বন্ধ ঘোষণা করেছে নিকন। এর মাধ্যমে তারা ৬৩ বছরের যাত্রার সমাপ্তি টানতে শুরু করেছে। 

ডিএসএলআর উৎপাদন বন্ধ করলেও ক্যামেরা তৈরি থামাচ্ছে না। এখন থেকে তারা মিররলেস জেড মাউন্ট, যেমন- জেড৬, জেড৫০ এবং সম্প্রতি লঞ্চ হওয়া জেড৯ ফ্ল্যাগশিপ মডেলগুলোর দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেবে। ইন্ডাস্ট্রিতে এটি একটি চমকপ্রদ পরিবর্তন। কারণ ১৯৫৯ সালে চালু হওয়া আইকনিক 'নিকন এফ'-এর পর এসএলআর ক্যামেরার সঙ্গে নিকনের একটি দীর্ঘ ইতিহাস তৈরি হয়েছে।

শুধু নিকন নয়, অন্যান্য ক্যামেরা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোও একই দিকে যাচ্ছে। ক্যানন ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছে যে, ইওস-১ডিএক্স মার্ক ৩ হবে তাদের চূড়ান্ত ফ্ল্যাগশিপ ডিএসএলআর এবং সনি গত বছর থেকে শুধু মিররলেস ক্যামেরা তৈরির দিকে ঝুঁকেছে।

ছবি: এনগেজেট

কিছুদিন আগ পর্যন্ত এসএলআর ক্যামেরাগুলোকে অ্যাকশন ফটোগ্রাফির জন্য মিররলেসের চেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাহলে হটাৎ এই পরিবর্তন কেন? 

সহজ কথায় বলতে গেলে, মিররলেস মডেলগুলো গত কয়েক বছরে নাটকীয়ভাবে এত বেশি উন্নতি করছে যে, তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিএসএলআরকে পিছিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। 

নতুন প্রযুক্তির মিররলেস ক্যামেরাকে হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। মিররলেস রিফ্লেক্স প্রযুক্তিকে শুধু ধরে ফেলেনি, শিগগিরই এই প্রযুক্তিকে অতিক্রম করে ফেলবে। অন্য কথায়, ভবিষ্যতের মিররলেস প্রযুক্তি আপনাকে ভুলিয়ে দেবে যে, ডিজিটাল ক্যামেরাগুলোর ভিতরে এক সময় মিরর থাকতো। 

প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফারদের এখনো যে কারণে ডিএসএলআর পছন্দ

অনেক প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফারের এখনো ডিএসএলআর ধরে রাখার প্রধান কারণ হলো এর গতি। এসএলআর ক্যামেরায় মিররের নিচে ডেডিকেটেড অটোফোকাস সেন্সর রয়েছে। অত্যন্ত দ্রুত হওয়ার কারণে এগুলো দিয়ে প্রতিটি শটে সঠিক ফোকাসসহ উচ্চ গতির বার্স্ট শুটিং করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ক্যাননের ১ডিএক্স ৩, অটো-ফোকাস এবং অটো-এক্সপোজার চালু রেখে ১৬ এফপিএস পর্যন্ত শুট করতে পারে।

অনেক ফটোগ্রাফার এখনো অপটিক্যাল ভিউফাইন্ডার পছন্দ করেন। তারা প্রিজম বা মিরর দিয়ে সাবজেক্টের এমন একটি দৃশ্য দেখতে চান, যা তারা বিশ্বাস করতে পারেন। এই দৃশ্য তাদের কাছে একটি কৃত্রিম ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে থেকে ভালো মনে হয়। কিন্তু সমস্যা তখনই হয় যখন, ছবি শুট করার সময় মিররটি উপরে উঠে যায় এবং সামনের দৃশ্য ব্লক করে দেয়।

আরেকটি বড় বিষয় হলো, এর ব্যাটারি লাইফ এবং হ্যান্ডলিং। ফ্ল্যাগশিপ ডিএসএলআরগুলো ভারী বডি এবং বড় গ্রিপ স্থিতিশীল শুটিং প্ল্যাটফর্মের জন্য ভালো। বিশেষ করে স্পোর্টস এবং ওয়াইল্ড-লাইফ ফটোগ্রাফিতে বিশাল টেলিফটো লেন্সগুলোর জন্য এগুলো বেশ উপযোগী। এ ছাড়া সহজ হ্যান্ডলিংয়ের জন্য রয়েছে অনেক ডায়াল এবং বোতাম। অন্যদিকে, অপটিক্যাল ভিউফাইন্ডার ব্যাটারি ব্যবহার করে না, তাই ডিএসএলআর একবার চার্জে অনেক ছবি তুলতে পারে।

ছবি: এনগেজেট

ডিএসএলআর-এর সাপেক্ষে মিররলেসের ব্যাটারি লাইফ এখনো একটি সমস্যা। যেখানে নিকন ডি৬ একবার চার্জে ৩ হাজার ৫৮০ শট শুট করতে পারে। সেখানে জেড৯ মাত্র ৭৭০টি পারে, যা একটি মিররলেস ক্যামেরার জন্যেও অনেক। আপাতত, মিররলেস এক্ষেত্রে একটি অসুবিধার মধ্যে আছে। তবে, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে দ্রুতই।

প্রতিযোগিতায় মিররলেস যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে

সম্প্রতিকালে, সবশেষ মিররলেস ক্যামেরাগুলো উপরিউক্ত উদ্বেগগুলোর বেশিরভাগই কমিয়ে এনেছে। মিররলেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো, স্ট্যাক করা সেন্সরের প্রবর্তন। এগুলোর দ্রুত রিডআউট গতির জন্য দ্রুত বার্স্ট শ্যুটিং এবং আরও সঠিক অটোফোকাস পাওয়া যায়।

ক্যাননের ইওস আর৩-এর একটি দুর্দান্ত উদাহরণ। এটি মেকানিক্যাল শাটার মোডে ১ডিএক্স মার্ক ৩ ডিএসএলআর-এর চেয়ে একটু ধীর, কিন্তু ইলেকট্রনিক শাটারে এটি অনেক দ্রুত এবং আরও বেশি রেজোলিউশন প্রদান করে। সনি এ১ আরও চমৎকার, যা আপনাকে ৩০ ফ্রেম পার সেকেন্ডে (এফপিএস), ৫০-মেগাপিক্সেলে ফ্রেম চালাতে দেয়।

সম্ভবত স্ট্যাক সেন্সরের ক্ষমতার সবচেয়ে প্রাণবন্ত প্রদর্শনী হলো নিকনের নতুন ফ্ল্যাগশিপ জেড৯। এটি ইলেকট্রনিক শাটার দিয়ে ২০ এফপিএস-এ ৪৬-মেগাপিক্সেলে 'র' ছবি শুট করতে পারে এবং এতে এমনকি মেকানিক্যাল শাটারও নেই। অন্যদিকে, নিকনের ফ্ল্যাগশিপ ডি৬ ডিএসএলআর প্রতি সেকেন্ডে ১৪টি করে 'র' ছবি তুলতে পারে, কিন্তু ২১ মেগাপিক্সেলে যা এর অর্ধেকেরও কম রেজুলেশন।

ছবি: এনগেজেট

ভিউফাইন্ডারের সমস্যাটিও অনেকাংশে সমাধান করা হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগেও মিররলেসের ইভিএফগুলো স্লো, কম রেজুলেশনের এবং অস্থিতিশীল ছিল। এমনকি ডিএসএলআর-এর ছবি তোলার সময় ভিউফাইন্ডারটি কালো হয়ে যাওয়ার সমস্যাটিও এতে ছিল। কিন্তু এখন বেশিরভাগ নতুন মিররলেস মডেলই রয়েছে শার্প এবং ফাস্ট অর্গানিক লাইট এমিটিং ডায়প (ওএলইডি) ডিসপ্লে। আর সবগুলোতেই বেশিরভাগ পরিস্থিতিতে ব্ল্যাকআউটমুক্ত শুটিং করা যায়। যেগুলো ফটোগ্রাফারদের অপটিক্যাল ভিউফাইন্ডারের চেয়ে ভালো দৃশ্য দেখার সুযোগ দিতে পারে।

অটোফোকাসের কথা যদি ধরি। যদিও ডিএসএলআর-এ ফাস্ট ডেডিকেটেড ফেস-ডিটেক্ট অটো-ফোকাস (এএফ) সেন্সর রয়েছে, মিররলেস মডেলগুলাতে সরাসরি প্রধান সেন্সরে আরও অনেকগুলো ফেস-ডিটেক্ট পিক্সেল রয়েছে। ক্যাননের ক্ষেত্রে, প্রতিটি পিক্সেল এএফ এর জন্য ব্যবহৃত হয়। যা তাত্ত্বিকভাবে, দ্রুত এবং আরও সঠিক অটো-ফোকাসের জন্য করে।

আধুনিক মিররলেস ক্যামেরাগুলো এআই-এর দিক থেকেও এগিয়ে আছে। বেশিরভাগই মানুষ, পাখি, প্রাণী, গাড়ি, ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাবজেক্ট, মুখ এবং চোখ শনাক্ত করতে পারে। যেটি অ্যাকশন ফটোগ্রাফিতে দ্রুত চলমান সাবজেক্ট ট্র্যাক করার জন্য বেশ উপযোগী। যে ক্ষেত্রটি আগে বিশেষভাবে রিফ্লেক্স ক্যামেরার অধীনে ছিল। 

ছবি: এনগেজেট

মিররলেসের স্ট্যাকড সেন্সরগুলো ঘূর্ণায়মান শাটারের সমস্যা দূর করে, যার ফলে নড়বড়ে, বিকৃত ছবি আসত। অন্যদিকে, এগুলো দ্রুত গতিশীল সাবজেক্ট সাইলেন্ট শুটিংয়ের সুবিধা দেয়, যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বেশ সুবিধাজনক। উদাহরণস্বরূপ, গল্ফ টুর্নামেন্টের সময়।

সম্ভবত এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ভিডিও। নিকন-এর জেড৯, কানন আর৩ এবং সনি এ১ বেশিরভাগ সিনে ক্যামেরার কাছাকছি। যা ডিএসএলআর-এর জন্য দ্বিগুণ হুমকি স্বরূপ। অবিশ্বাস্য ভিডিও অটোফোকাস সিস্টেম ৮-কে পর্যন্ত রেজুলেশনে 'র' ভিডিও ক্যাপচার, চমৎকার অডিও ক্ষমতাসহ, আরও বেশ কিছু সুবিধার জন্য মিররলেস ক্যামেরা ভিডিওর ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে।

ডিএসএলআর-এর বিপরীতে, বেশিরভাগ মিররলেস ক্যামেরায় ইন-বডি স্ট্যাবিলাইজেশন থাকে। তাই আপনাকে লেন্সে সেই ফিচারটি থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। আর লেন্সের কথা বললে, মিররলেস ক্যামেরার জন্য ডিজাইন করা লেন্সগুলো আকারে ছোট, হালকা এবং অপটিক্যালি অধিকতর ভালো। কারণ পিছনের অংশটি সেন্সরের বেশি কাছাকাছি থাকে।

সনি সম্প্রতি নতুন সেন্সর উন্মোচন করেছে, যা বর্তমান স্ট্যাক করা সেন্সরগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ আলো পায়, যা কম আলোতেও দ্রুত শুটিংয়ের পথ উন্মোচন করেছে। এ ছাড়া আপনি অদূর ভবিষ্যতে আরও দ্রুত ইমেজ প্রসেসর, আরও ভালো ইভিএফ এবং স্মার্ট এএফ সিস্টেম আশা করতে পারেন। 

ছবি: এনগেজেট

তারপর দাম এবং খরচের ব্যাপারটি দেখা যাক। মিররলেস ক্যামেরাগুলো ডিএসএলআর-এর তুলনায় কম জটিল হওয়ায় তুলনামূলক সস্তা। উদাহরণস্বরূপ, নিকন-এর জেড৯-এর দাম ডি৬ এর থেকে ১০০০ ডলার কম এবং ক্যানন ইওস আর৩-এর দাম ১ডিএক্স মার্ক-৩-এর থেকে ৫০০ ডলার কম।

পরিশেষে

স্মার্টফোনের কারণে ক্যামেরার বাজারে পতন ঘটার পর ডিএসএলআর কিংবা মিররলেস উভয়ই ক্যামেরা নির্মাতাদের কাছে খুব একটা অর্থবহ নয়। তাই তারা ব্যবসায়ীক সুবিধার্থে একটি প্রযুক্তিতে মনোনিবেশ করছে বলে মনে হচ্ছে।

অনেক ফটোগ্রাফারের দুঃখ পেতে পারেন এই ভেবে যে, ডিএসএলআর ক্যামেরার দীর্ঘ যাত্রা শেষ হতে চলেছে। বিশেষ করে যারা নতুন কিনেছেন। তবে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। নিকন এবং ক্যানন নতুন ডিএসএলআর এবং লেন্স ডিজাইন করা বন্ধ করে দিলেও বিদ্যমান মডেলগুলো তৈরি এবং বিক্রি চালিয়ে যাবে।

 তথ্যসূত্র: এনগ্যাজেট, ইটেক

গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি

 

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago