সেলিমের ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি

নিজের সংগ্রহশালায় ইসমাইল হোসেন সেলিম। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

একদিন সাপ্তাহিক বাজারের জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ইসমাইল হোসেন সেলিম (৬৮) । পথে এক বন্ধুর কাছে খবর পান, একজন দুর্লভ একটি ল্যান্ড ফোন সেট বিক্রি করবেন। শোনামাত্রই দেরি না করে সেলিম সেখানে যান। বাজারের পরিবর্তে ১ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে ফোন সেটটি কিনে বাসায় ফেরেন তিনি।

ঘটনাটি ২০১৩ সালের।

এই সমাজের অধিকাংশ মানুষের স্বপ্ন তার নিজেকে ঘিরে। তবে কিছু মানুষ আছেন যাদের স্বপ্ন শুধু নিজেকে ঘিরে নয়, আরও বিস্তৃত পরিসরে। টাঙ্গাইলের ইসমাইল হোসেন সেলিম তেমনি একজন।

তার স্বপ্ন—শখের বশে যেসব দুর্লভ পুরনো জিনিস তিনি সংগ্রহ করেছেন সেগুলোর উপযুক্ত ঠিকানা করে দেওয়া। দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও তার সেই স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি।

ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

পরম যত্নে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা সংগ্রহগুলোর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে নিজ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আশা তিনি পুষে রেখেছেন।

সেলিমের জন্ম টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া এলাকায় ১৯৫৫ সালে। বাবা গোলাম সরোয়ার ছিলেন টাঙ্গাইল পৌরসভার সচিব। সেলিম লেখাপড়া করেছেন শহরের মডেল প্রাইমারি স্কুল, বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, কাগমারীর মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ ও করটিয়ার সাদত কলেজে।

কলেজ পাশ করে ১৯৭০ সালে স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেও পরে সে চাকরি ছেড়ে যোগ দেন টাঙ্গাইল পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে। পরে ২০১৩ সালে ওই পৌরসভার সচিব হিসেবে অবসর নেন।

ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

ছোটবেলা থেকেই সেলিমের শখ বিভিন্ন দেশের ডাক টিকিট জমানোর। ছবি আঁকায় তার দক্ষতা ছিল। এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও, তার আছে দারুণ সব চিত্রকর্ম। এর অধিকাংশই টাঙ্গাইলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর। ক্যালিওগ্রফিতেও দক্ষ তিনি।

তবে এসব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে নিজ বাড়িতে রাখা তার সংগ্রহগুলো। সেখানে আছে ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তৈরি হওয়া শতাধিক ল্যান্ড ফোন সেট, এগুলোর অধিকাংশই এখনো সচল।

টেলিফোন সেটগুলোসহ অধিকাংশ সংগ্রহই তিনি অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কিনেছেন।

তার সংগ্রহে আছে ১৬৪ দেশের কাগজের নোট, পুরনো দিনের গ্রামোফোন ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র। রয়েছে ৪২ ভাষায় অনূদিত কোরআন শরিফ। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর শত শত বই।

গুণীজনদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করাও ছিল সেলিমের আরেক নেশা। তিনি সংগ্রহ করেছেন রোনাল্ড রিগ্যান, নেলসন ম্যান্ডেলা, কফি আনান, বুট্রোর্স ঘালি, মাদার তেরেসা ও ডব্লিউ এস এ উডারল্যান্ডসহ বহু বরেণ্য মানুষের অটোগ্রাফ।

অটোগ্রাফগুলো তিনি সংগ্রহ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে। তবে মাদার তেরেসার অটোগ্রাফটি সংগ্রহের জন্য ১৯৯৩ সালে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন।

নিজের সংগ্রহগুলোর মধ্যে সেলিমের সবচেয়ে প্রিয় ১৯৪০ সালে ইংল্যান্ডে তৈরি ৮এমএম সাইলেন্ট ফিল্ম প্রজেক্টর। এটি এখনো সচল আছে। এটি তিনি এক আত্মীয়ের মাধ্যমে লন্ডন থেকে কিনে এনেছিলেন।

এসবের ওপর প্রতিদিন পড়া ধূলা ঝেড়ে সময় কাটে অবসরে যাওয়া এই মানুষটির। মৃত্যুর পর প্রাণপ্রিয় সংগ্রহগুলোর ভাগ্যে কী ঘটবে ভেবে বিষন্ন হয়ে পড়েন।

জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছায় তিনি জেলা শহরে সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তার প্রিয় এক ছাত্র ও স্থানীয় ব্যবসায়ী মির্জা মাসুদ রুবল। চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু, এগুতে পারেনি বেশি দূর।

মির্জা মাসুদ রুবল বলেন, 'সেলিম স্যার অসাধারণ মানুষ। তার ইচ্ছা টাঙ্গাইলে সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার। জেলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিভিন্ন নিদর্শনের পাশাপাশি সেখানে থাকবে তার নিজের সংগ্রহগুলো।'

'জীবনের শেষ দিনগুলোয় সেখানে বসে তিনি নতুন প্রজন্মকে জেলার সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। কিন্তু, গত কয়েক বছর অনেক চেষ্টা করেও তিনি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠায় সফল হতে পারেনি।'

তিনি আরও বলেন, 'জেলা শহরে সংগ্রহশালা স্থাপনের জন্য আমরা উনাকে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিসহ অনেকের কাছেই গিয়েছি। কোনো লাভ হয়নি। শহরে সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা পাওয়া যায়নি।'

'স্বল্প আয়ের স্বামীর এসব সখের জন্য সংসার চালাতে বেশ হিমসিম খেতে হচ্ছে' উল্লেখ করে ইসমাইল হোসেন সেলিমের স্ত্রী জাহানারা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক সময় এই সংগ্রহগুলো শোয়ার ঘরে রাখা হতো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে শোয়ার জায়গাই থাকলো না। অনেক আপত্তির পর শেষে সেগুলো অন্য রুমে রাখা হয়েছে।'

ইসমাইল হোসেন সেলিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এটি করতে না পারলেও এক সময় কেউ না কেউ নিশ্চয়ই করবেন। টাঙ্গাইলের মতো সমৃদ্ধ জেলায় সংগ্রহশালা থাকবে না তা কি হয়?'

Comments

The Daily Star  | English

Child rape cases rise nearly 75% in 7 months

Child rape cases in Bangladesh have surged by nearly 75 percent in the first seven months of 2025 compared to the same period last year, according to data from Ain o Salish Kendra (ASK).

5h ago