জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে ইন্ধন দিচ্ছে, কথা সত্য: পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। ছবি: সংগৃহীত

'সহসাই কমছে না মূল্যস্ফীতির চাপ। আরও কিছুদিন দেশে পণ্য ও সেবা মূল্যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকবে। তবে কতদিন থাকবে বা মূল্যস্ফীতির হার কোন পর্যায়ে ঠেকবে তার পুরোটাই নির্ভর করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির ওপর।'

আজ রোববার অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত 'বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ' বিষয়ক এক আলোচনা সভায় সরকারের নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এমন মতামত দিয়েছেন।

তবে অনুষ্ঠানে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা, ব্যবসার বিধি-বিধানসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচকদের মধ্যে মতপার্থক্যও দেখা গেছে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম দেশের অর্থনীতিবিদদের 'আশঙ্কাবাদী' বলে উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, 'অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতির অর্জন ও সম্ভাবনা দেখতে পান না। কিন্তু বিদেশি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তি ও সম্ভাবনা তুলে ধরছে।'

অপরদিকে, ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যতে দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ব্যবসার বিধি-বিধান সহজ করার সুপারিশ করেন।   

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, 'জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে ইন্ধন দিচ্ছে। এ কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, কথা সত্য। দাম না বাড়িয়ে বিকল্প ছিল না। তবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে- অক্টোবরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ পরিকল্পিতভাবে এগুচ্ছে। পরিকল্পনায় কোনো দুর্বলতা নেই। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ অস্বস্তিতে আছে, কোনো সংকটে নেই। এলডিসি থেকে উত্তরণ, এসডিজি বাস্তবায়ন সবই ঠিকভাবে হবে। তবে দারিদ্র পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।'

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'দেশে উন্নতমানের কয়লা মজুদ আছে। একসময় কথা উঠেছিল উন্নতমানের কয়লা থাকতে আমদানি করা হচ্ছে। সেটা করা হয়েছে দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়ার কারণে। কখনো কখনো অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দিতে হয়। কয়লা উত্তোলনে কৃষি জমি দেবে যেতে পারে, ধসে যেতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে আমাদের জমির স্বল্পতা আছে, সেখানে এ ধরনের আশঙ্কা থাকলে সেটা করা ঠিক না। অনেক দেশে কয়লার খনি এলাকা লেক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি। এজন্য কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত।'

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি কাজ করছে না। সামনে আরও দুঃসময় আসছে। মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে ঠেকতে পারে। লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি সহসাই কমবে না। যদিও আগামীতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়বে। আমদানি কিছুটা কমে আসবে। বৈদেশিক লেনদেনে যে ভারসাম্য দরকার তা মোটামুটিভাবে হবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু করা হয়নি। সরকার সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কিন্তু চালের উৎপাদন কম হয়েছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমনের চাষও ভালোর আশা করা যাচ্ছে না। চালের দাম বাড়বে। বাজারকে দোষ দিলে হবে না। চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও প্রয়োজনীয় আমদানি হয়নি।'

তিনি বলেন, 'সরকার বাজেট ব্যবস্থাপনায় ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। এরপরও বাজেট বাস্তবায়নে বিদেশ থেকে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আনতে হবে। দেশের ব্যাংক থেকেও এক লাখ কোটি টাকার বেশি নিতে হবে।'

ফলে পরিস্থিতির উন্নতির জন্য রাজস্ব ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, 'মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে। তবে এই মূল্যস্ফীতি পুরোটাই আমদানিজনিত। এরপরও বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য সুদহার না বাড়িয়ে সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে- ডলারের বিনিময় হার শিগগির কমে আসবে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নতি হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে আছে।'

বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, 'রপ্তানি আদেশ কমছে। বড় বড় কারখানা উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি খরচের সমন্বিত মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে, সরকার যে প্রণোদনার ঋণ পরিশোধে কম সময় দিয়েছে, এতে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া, বন্ড লাইসেন্স, এইচএসকোডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এনবিআরের পলিসি ব্যবসায়ী পরিপন্থী। আইন দ্বারা ব্যবসায়ীদের ওপর জুলুম, নির্যাতনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যতই চ্যালেঞ্জ আসুক বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে থাকবে।'

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, 'দেশে কয়লার যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। নিজস্ব যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। জ্বালানিতে আমদানি নির্ভরতা এমন পর্যায়ে গেছে যে, এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।'

তিনি বলেন, 'অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনায় কিছু দুর্বলতা রয়েছে। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে না উঠলে ভবিষ্যৎ খারাপ হবে। প্রতিযোগিতামূলক থাকা এখন প্রথম চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া, নীতি-নির্ধারণী পদ্ধতির কারণে ব্যবসায় নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এটাও বড় চ্যালেঞ্জ।'

নিহাদ কবির আরও বলেন, 'চাল, মাছ, মুরগির দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের সমস্যা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসছে, সেটা সমন্বয় করতে হবে।'

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, 'জ্বালানি নিরাপত্তা খুবই জরুরি। অবশ্যই জ্বালানিতে বিপ্লব হয়েছে। দেশের অর্থনীতি যে গতি পেয়েছে সেখানে জ্বালানির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এখনকার জ্বালানি আমদানি নির্ভর। এ বিষয়টি পুনরায় চিন্তা করার সময় এসেছে। দেশে যে কয়লা ও গ্যাসের ব্যবহার করতে হবে, এজন্য মাস্টারপ্ল্যান করা উচিত। যাতে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে মধ্যে জ্বালানি স্বনির্ভর হয় দেশ।'

রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন রিনভী। ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংগঠনের সিনিয়র সদস্যরা চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতামত তুলে ধরেন।

Comments

The Daily Star  | English

Child rape cases rise nearly 75% in 7 months

Child rape cases in Bangladesh have surged by nearly 75 percent in the first seven months of 2025 compared to the same period last year, according to data from Ain o Salish Kendra (ASK).

5h ago