‘জয় কখনো দলে বা মন্ত্রণালয়ে পদ নেওয়ার কথা চিন্তা করেনি’

এএনআইকে বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: এএনআই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ভারত সফর করবেন। তার ভ্রমণসূচি অনুযায়ী, ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নয়াদিল্লি পৌঁছাবেন তিনি। ৬ সেপ্টেম্বর তার সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। একই দিন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন তিনি।

এই সফরের প্রাক্কালে ভারতীয় গণমাধ্যম এএনআই শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টায়। ঢাকায় এসে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এএনআইয়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশ।

ইংরেজি সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করে দ্য ডেইলি স্টার বাংলার পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

এএনআই: সম্প্রতি সংখ্যালঘু হিন্দুদের উদ্দেশে আপনি বলেছেন, 'আপনাদের ততটাই অধিকার আছে, যতটা আমার আছে।' কোনো একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যালঘুদের জন্য এটি একটি বড় নিশ্চয়তা প্রদান। তারপরও ভারতীয়রা বিভিন্ন ভিডিওতে দেখতে পান যে মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে, হামলা হয়েছে, এমন বিভিন্ন ঘটনা। যদিও এর সংখ্যা কম। আপনি কি মনে করেন যে বাংলাদেশে সংখ্যাগুরুদের মতোই সংখ্যালঘুরাও নিরাপদ?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা: আমরা ক্ষমতায় থাকাকালীন এই বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। আমি সবসময় তাদের বলেছি, আপনারা আমাদের নাগরিক, আপনাদের বাংলাদেশকে নিজের মনে করতে হবে। মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা ঘটে যায়। এগুলো অপ্রত্যাশিত। তবে, সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও অনেক সময় সংখ্যালঘুরা ভুক্তভোগী হন।

বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এ দেশে অনেক ধর্মের মানুষ বসবাস করেন। এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি আছে। আমার সরকার এবং দলীয় নেতাকর্মীরা এ বিষয়ে সব সময় সচেতন থাকে। কোনো ধরনের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। আমার মনে হয়, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরও বেশি পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

এএনআই: আপনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্লগার কমিউনিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি করেন যে, ইসলামিক চরমপন্থিরা এখন বাংলাদেশকে চরমপন্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

শেখ হাসিনা: দেখুন, চরমপন্থিরা সব দেশেই আছে। এমনকি ভারত বা বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে আপনি সেটা দেখতে পাবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহজলভ্য হওয়ায় সেখানে অনেক সময় অনেকে অনেক কিছু লিখছেন। ব্লগাররাই নয় শুধু, অনেক সময় অন্য ধর্মের মানুষও লিখছেন। কিন্তু চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমরা কখনোই এগুলোকে সমর্থন করি না।

নিজের ধর্ম পালনে সবারই সমান অধিকার আছে। অন্য ধর্মের মানুষকে আঘাত করে, এমন কথা কারোই বলা উচিৎ না। প্রতি ধর্মের উৎসবই প্রত্যেকের পালন করা উচিত সাংস্কৃতিক উৎসবের মতো। বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সময় দেখতে পাবেন, পুরো দেশে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। সবাই একসঙ্গে উদযাপন করে। কাজেই, ধর্মীয় সম্প্রীতি এখানে আছে।

এএনআই: সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক সহযোগিতা রয়েছে। তারপরও ভারত থেকে গবাদিপশু পাচারের বিষয়টি রয়েই গেছে। এ বিষয়ে কি আরও বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন?

শেখ হাসিনা: ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং এমন ঘটনা অনেক কমেও গেছে। তারপরও অনেক সময় এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ এখন আর ভারতের গবাদিপশুর ওপর নির্ভরশীল না। আমরা দেশেই পর্যাপ্ত পরিমাণ গবাদিপশু উৎপাদন হচ্ছে, কারণ আমাদের জন্যই সেটা প্রয়োজন। তারপরও সীমান্তের এই সমস্যা সমাধানে ২ দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী আলোচনা করছে। আমরা তাদের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পাচ্ছি যে এটা কমছে। নিশ্চই এটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

এএনআই: আরেকটি বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা। ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে, বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এখানে মানবিক বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনি তাদেরকে নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়েও দাবি বাড়ছে, অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

শেখ হাসিনা: আমাদের জন্য এখন এটি একটি বড় বোঝা। ভারত অনেক বড় দেশ, আপনারা তাদের জায়গা দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের এত বেশি জায়গা নেই। বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক মহলে এ বিষয়ে কথা বলছি, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলছি, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ব্যবস্থা নেয়।

মানবিক কারণে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি এবং তাদের জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করছি। তাদের সবাইকে করোনার টিকাও দিয়েছি। কিন্তু তারা কতদিন এখানে থাকবে? যে ক্যাম্পে তারা থাকছে, সেখানে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের অনেকে মাদকচোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত, নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত, সশস্ত্র বিরোধে জড়াচ্ছে। দিন দিন সেগুলো বাড়ছে। কাজেই, যত দ্রুত তারা ফিরে যাবে ততই তা আমাদের জন্য এবং মিয়ানমারের জন্য ভালো হবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি।

সেই সময় (রাখাইনে সামরিক জান্তাদের অত্যাচারের সময়) রোহিঙ্গারা ভয়ানক বিপদে ছিল। আমরা তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। এখন তাদের নিজ দেশে ফেরা উচিত। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত এ বিষয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

এএনআই: ভারতে এখন পারিবারিক রাজনীতি নিয়ে অনেক আলোচনা রয়েছে। এটাকে বলা হচ্ছে ক্ষতিকর। বাংলাদেশে এটা কোনো ইস্যু না বলে মনে করেন কি?

শেখ হাসিনা: হ্যাঁ, এটা কোনো ইস্যু না।

এএনআই: আপনি কি চান যে আপনার ছেলে (সজীব ওয়াজেদ জয়) রাজনীতিতে আসুক?

শেখ হাসিনা: সে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি তার উপর। কিন্তু সে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা করেছি। স্যাটালাইট, সাবমেরিন ক্যাবল, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ— ডিজিটাল সিস্টেমের সবকিছু হচ্ছে তার পরিকল্পনায় এবং সে আমাকে সহযোগিতা করছে। কিন্তু সে কখনো দলে বা মন্ত্রণালয়ে কোনো পদ-পদবী নেওয়ার কথা চিন্তা করেনি। দলীয় সম্মেলনে তার জন্য অনেকে দাবি জানায়। তখন তাকে আমি বলি, মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তাদের বলো যে তুমি কী চাও। সে সেটা করেছে। সে বলেছে যে আমি এখন দলের কোনো পদ চাই না। তারচেয়ে বরং যারা কাজ করছে তাদের এসব পদ পাওয়া উচিৎ। কেন আমি একটি পদ দখল করে রাখব। আমি আমার মায়ের সঙ্গে কাজ করছি, দেশের জন্য কাজ করছি, করে যাব।

এভাবেই সে চিন্তা করে। আমি তাকে রাজনীতিতে আনব বিষয়টি তেমন নয়। এটা নির্ভর করছে জনগণের ওপর।

এএনআই: বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বের আলোচনায় রয়েছে যে বাংলাদেশে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। আপনার দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই কেন?

শেখ হাসিনা: আমাদের বিরোধীরা যথেষ্ট শক্তিশালী, দুর্বল না।

এএনআই: শক্তিশালী বিরোধীরা শুধু দেখতে চায় যেন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে। আমি এমন বিরোধী দলের কথা বলছি, যাদের চাওয়া কেবল এটাই নয় যে শেখ হাসিনাকে হটাও।

শেখ হাসিনা: ঠিকই বলেছেন। তারা আমাকে বারবার হত্যাচেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি বেঁচে গেছি। দিনের আলোতে আমার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। জানি না কীভাবে বেঁচে গেলাম। আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা আমাকে ঘিরে ধরে মানব ঢাল তৈরি করেছিল। আমার জনসভায় গুলি চালানো হয়েছে, আমি বেঁচে গেছি। আমার জনসভার মঞ্চের নিচে বোমা রাখা হয়েছে, ভাগ্যক্রমে এক চা বিক্রেতা সেটা দেখে ফেলে। আল্লাহ আমাকে সহযোগিতা করছেন। হয়তো আল্লাহ আমাকে কিছু কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।

আমাদের দেশে ২টি বিরোধী দলের, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি, সূচনা করেছে সামরিক একনায়ক। প্রথমে তারা ক্ষমতা দখল করেছে, তারপর তারা পোশাক বদলে রাজনীতিবিদ হয়েছে। তারা সরকার গঠন করেছে, যখন তারা ক্ষমতা দখল করে ছিল। ক্ষমতায় থেকে যখন কেউ দল গঠন করে, তখন তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের তেমন যোগাযোগ থাকে না। কিন্তু এই উপমহাদেশে আওয়ামী লীগ একটি প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। আমাদের শিকর ও ক্ষমতা হচ্ছে আমাদের জনগণ। জনগণ দেখছে যে এই দলটি ক্ষমতায় থাকলে তারা তাদের ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তা পায়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। আমরা বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করছি; বিধবা, প্রবীণ, প্রতিবন্ধীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছি, তাদের অর্থ সহায়তা দিচ্ছি; ভূমিহীনরা ঘর পেয়েছে; বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। আমরা শিক্ষা বিস্তারে কাজ করছি। আমি প্রতিটি খাত বেসরকারি ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি এবং সব ধরনের প্রণোদনাও দিচ্ছি। কারণ আমি চাই সবার কর্মসংস্থান হোক।

এএনআই: বিরোধী দল না থাকলে আপনি যে কাজগুলো করছেন সেগুলো আর কে করতে চাইবে? বিষয়টি কি এমন?

শেখ হাসিনা: আমাদের ইতিহাস দেখলে দেখতে পাবেন, অন্যান্য দল যখন ক্ষমতায় ছিল, দেশের অবস্থা কী ছিল। শুধু ক্ষমতায় আসতে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে তারা আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে। তারা মানুষ হত্যা করেছে, বোমা হামলা করেছে, বাস-ট্রেন-প্রাইভেট কার-অটোরিকশায় আগুন দিয়েছে। বিরোধী দলে থাকলে এটা তাদের আন্দোলনের নমুনা। মানুষ যখন দেখছে যে বিরোধী দলে থাকলে তারা মানুষ হত্যা করছে তখন তাদেরকে সমর্থন কেন দেবে। ক্ষমতায় থেকে তারা দুর্নীতি করেছে, প্রচুর টাকার মালিক বনে গেছে। তাদের সময়ে সন্ত্রাস হয়েছে। কল্পনা করতে পারবেন যে এই দেশে একদিনে এক ঘণ্টার মধ্যে ৫০০ জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ— সবকিছু মিলিয়ে মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। সেটাই মূল কথা।

যখন আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলো, আমরা দেশের উন্নয়নে কাজ করেছি। আমরা প্রতিশোধ নেইনি। আমাদের সক্ষমতার সবটুকু দিয়েছি শুধুই দেশের উন্নয়নে।

দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি আমাকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে বলছিলেন, অথচ বাংলাদেশ পদ্মা সেতু তৈরি করেছে নিজের টাকায়। এর জন্য আমরা কারো কাছ থেকে কোনো টাকা নেইনি। আমি মানুষকে দেখিয়েছি, আমরা যদি চাই তাহলে আমরা করতে পারি।

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago