বিশ্বব্যাপী বাড়ছে সিলেটের লেবু জাতীয় ফলের চাহিদা

সিলেটের লেবু জাতীয় ফলের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

একটি লেবু জাতীয় ফলের জন্য সর্বোচ্চ কত টাকা খরচ করা যায়? যদি মনে হয় সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ৪০ টাকা খরচ করা যায়, তাহলে উত্তরটি একদমই সঠিক নয়। সিলেট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় লেবু জাতীয় ফল (সাইট্রাস) আছে, যা ২ কেজি বা তারও বেশি হয় এবং একেকটি লেবু স্থানীয় বাজারে ১ হাজার টাকা দামেও বিক্রি হয়।

বিখ্যাত এই লেবু জাতীয় ফলটি স্থানীয়ভাবে 'জারা' নামে পরিচিত। বড়, ডিম্বাকার, সুগন্ধি ও সুস্বাদু এই সাইট্রাস জাতীয় ফলটি মূলত একটি সাইট্রন, যা কয়েক শতাব্দী ধরে সিলেট অঞ্চলের মানুষের রসনা বিলাসের অন্যতম একটি উপকরণ।

এ জাতীয় ফলের গুরুত্ব সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে এতটাই বেশি যে শুধু জারা নয়, এ ছাড়াও, এলাচিগন্ধী লেবু 'শাসনী'র ব্যাপক চাহিদা আছে। জারা ও শাসনী ২টি লেবুর খোসা মূলত খাবারের অনুষঙ্গ সালাদ হিসেবে খাওয়া হয়।

সিলেটের লেবু জাতীয় ফলের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

শুধু এই দুটি নয়, সিলেট অঞ্চলের মানুষের পছন্দের তালিকায় আছে 'সাতকরা' ও 'আদা জামির'। সাতকরার খোসা মূলত মাংস রান্নায় ব্যবহার করা হয় সুগন্ধি হিসেবে। এ ছাড়া আচার হিসেবেও ব্যবহার হয় সাতকরা। আর সুগন্ধি আদা জামির খাওয়া না গেলেও মাছ রান্নায় ব্যবহৃত হয় সুগন্ধি অনুষঙ্গ হিসেবে।

এসব লেবু জাতীয় ফল দিনদিন এত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে যে শুধু সিলেট অঞ্চল নয়, সিলেট ছাড়িয়ে সারাদেশে যেমন বিক্রি হচ্ছে, তেমনি বিশ্বব্যাপী বাড়ছে এর চাহিদা।

সিলেট নগরীর লালবাজারে আকৃতিভেদে একটি 'জারা' বিক্রি হয় ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর 'শাসনী' প্রতিটি ১৪০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়।

লালবাজারে ১ হালি (৪টি) সাতকরা বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৪০০ টাকা দরে। আর এক হালি আদা জামির বিক্রি হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকায়।

লালবাজারের লেবু বিক্রেতা জায়েদ আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দিনে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকার বিভিন্ন জাতের লেবু বিক্রি হয়। তবে প্রবাসীরা দেশে আসলে বিক্রি বেড়ে দৈনিক ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকাও হয়।'

সিলেটের লেবু জাতীয় ফলের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

বিদেশে এসব ফলের দাম অন্তত ৩ গুণ বেশি। তাই প্রবাসী সিলেটিরা দেশে আসলে ফিরে যাওয়ার সময় প্রচুর লেবু জাতীয় ফল কিনে নিয়ে যান বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৭ দশমিক ৩৫ লাখ ডলারের লেবু জাতীয় ফল এবং ২০ হাজার ডলারের লেবু জাতীয় ফলের খোসা বিদেশে রপ্তানি করেছে।

সিলেট অঞ্চলের সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে লেবু জাতীয় ফলের চাষ হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমে মৌলভীবাজার জেলার ১ হাজার ৭০২ হেক্টর জমিতে ২৭ হাজার ৩২ টন এবং সিলেট জেলার ১ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমিতে ৯ হাজার ৯৩৪ টন লেবু জাতীয় ফল উৎপাদন হয়।

অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. ফারুক হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিলেট থেকে লেবু জাতীয় ফল বেশি পরিমাণে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু, সব রপ্তানি রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে হয়।'

সিলেটের লেবু জাতীয় ফলের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লেবু জাতীয় ফল রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। এ কারণে সিলেট অঞ্চলের লেবু চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন না এবং এ কারণে উৎপাদনও দ্রুত বাড়ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

উন্নত জাতের লেবুজাতীয় ফসলের উন্নয়নে ১৯৬০ সাল থেকে কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীনে 'সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র'। এটি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত।

দীর্ঘ গবেষণায় এ গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবন করেছে ২১টি লেবুর জাত। সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র ১টি জারা, ১টি সাতকরা, ৩টি কমলা, ২টি মাল্টা, ৬টি বাতাবি লেবু, ১টি মিষ্টি লেবু, ১টি কাগজী লেবু ও ৬টি সাধারণ লেবুর জাত উদ্ভাবন করেছে।

জারা ও সাতকরার ব্যাপক চাহিদা বাড়তে থাকলেও, এ ২টি ফলের উচ্চ ফলনশীল জাতের সংকট আছে। তা ছাড়া সাতকরার চাহিদা সিলেট অঞ্চলেই এতটা ব্যাপক যে ভারতের আসাম থেকেও সাতকরা আমদানি করা হয়।

সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এম এইচ এম বোরহানউদ্দিন ভুঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাতকরা বন্য প্রকৃতির গাছ। বন্য পরিবেশ ছাড়া এটি বেড়ে উঠতে পারে না। তা ছাড়া সাতকরা গাছের বৃদ্ধিও ধীরগতির। তাই কৃষকরা সাতকরা চাষে বেশি আগ্রহী না। তবে, জারাসহ অন্যান্য লেবু জাতীয় ফলের চাহিদা ও চাষাবাদ দ্রুত বাড়ছে।'

গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রতি বছর অন্তত ১০ হাজার লেবু জাতীয় গাছের চারা কৃষক ও চারা উৎপাদনকারীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে দ্রুত বাড়ছে লেবু জাতীয় ফলের চাষ।

সিলেটের লেবু জাতীয় ফলের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শাহ মো. লুৎফুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জারা-সাতকরাসহ চাহিদাসম্পন্ন লেবু জাতীয় ফলের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে গবেষণা কেন্দ্র। ইতোমধ্যে কেন্দ্রের ৪টি ল্যাবরেটরি— মলিকুলার বায়োলজি, পমোলজি, টিস্যু কালচার ও প্লান্ট ফিজিওলজিতে অত্যাধুনিক গবেষণা সরঞ্জাম আনা হয়েছে।'

শিগগির লেবু জাতীয় ফলের গবেষণা ও উৎপাদনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে জানান তিনি।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিদ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিলেট অঞ্চলের উৎপাদিত লেবুর চাহিদা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কিন্তু, সিলেট বিমানবন্দরে ওয়্যারহাউস, প্যাকিং স্টেশন ও সার্টিফিকেশন সেন্টার না থাকায় রপ্তানি করতে আমাদের ঢাকা বিমানবন্দরমুখী হতে হচ্ছে।'

সিলেট বিমানবন্দরে এসব সুবিধা চালু করতে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটে অনুষ্ঠিত কৃষি বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রীর হাতে স্মারকলিপি দেওয়া হলেও, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
G7 statement on Israel Iran war

Sirens sounded after missiles launched from Iran, says Israeli army

Revolutionary Guards say missiles targeted industrial areas in Israel

11h ago