মুক্তিযুদ্ধ

ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান, স্বীকৃতি মেলেনি আজও

শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

পেরিয়েছে স্বাধীনতার ৫১ বছর, গড়িয়েছে অজস্র জল। অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে আজও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান।

১৯৭৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য হাফিজুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা মোট আবেদন করেছেন ৮ বার। কিন্তু প্রতিবারই তার পরিবারের আবেদন বাতিল হয়েছে। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।  

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার আরবান গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনের দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সৈয়দ হাফিজুর রহমান। পরিচিত ছিলেন গেরিলা হাফিজ এবং মাইন হাফিজ নামেও।

অংশ নিয়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের একাধিক চরম ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকায় কেবল এক রাতে সফলভাবে ৬টি স্থানে মাইন বিস্ফোরণে অসামান্য কৃতিত্বও ছিল হাফিজুর রহমানের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের দশম খণ্ডেও উল্লেখ আছে এই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার কৃতিত্ব।

মুক্তিযুদ্ধের জুলাই-আগস্ট মাসে গাজী গোলাম দস্তগীর, বীর প্রতীকের নেতৃত্বে অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশনে অংশ নিয়ে সফলভাবে ৩০/৪০/৫০ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন হাফিজ। যে বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল ঢাকার গোটা পূর্বাঞ্চল।

মুক্তিযুদ্ধের ২৯ আগস্ট রাতে সৈয়দ হাফিজুর রহমানের ২০/ নিউ ইস্কাটনের বাড়িতে রেইড চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। সেই বাড়িতে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ খুঁজে পায়। ক্র্যাক প্লাটুনের ধরা পড়া বাকি গেরিলাদের মতো হাফিজুর রহমানকেও নেওয়া হয় এমপি হোস্টেল সংলগ্ন মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখানে তার ওপর চালানো হয় চরম পৈশাচিক নির্যাতন। তারপরও কোনো তথ্যই প্রকাশ করেননি তিনি।

২০১৪ সালে আবেদন করেছিলেন শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমানের বোন সৈয়দা আনোয়ারা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত

টর্চার সেল থেকে ফিরে আসা ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাফিজ ভাইয়ের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনে তার ২ চোখ বেরিয়ে গেছে। সারা শরীরে ছিল মারের দাগ। তিনি এক পর্যায়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বলছিলেন, ''আমাকে গুলি কর, আমি বেঁচে যাই।'' তিনি কোনো তথ্যই স্বীকার করেননি।'

মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের প্রায় সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। পাননি শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান। খেতাব তো দূরের কথা, আজ পর্যন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও পাননি তিনি।

সম্প্রতি তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এই প্রতিবেদকের। পরিবারের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সৈয়দ হাফিজুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য ১৯৭৪, ১৯৮৫, ১৯৯০, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে আবেদন করেছিলেন তার মেজ ভাই সৈয়দ মতিয়ুর রহমান, মেজ ভাইয়ের মেয়ে সৈয়দা মনোয়ারা খাতুন, ছোট ভাই সৈয়দ মুসাদ্দেকুর রহমান এবং ছোট বোন আনোয়ারা খাতুন। কিন্তু অজানা কারণে প্রতিবারই তাদের আবেদন ব্যর্থ হয়েছে।

সবগুলো আবেদনপত্রের অনুলিপিই এসেছে ডেইলি স্টারের হাতে। আবেদনপত্রগুলোর মধ্যে একটি ২০১৩ সালে করা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর সেই আবেদনপত্রটি ছিল 'শহীদ হাফিজুর রহমানের নাম বাংলাদেশ গেজেটে লিপিবদ্ধ করার জন্য আবেদন'। আবেদনটি করেছিলেন হাফিজুর রহমানের ছোট ভাই সৈয়দ মুসাদ্দেকুর রহমান।

১৯৮৫ সালে সৈয়দ হাফিজুর রহমানের ভাই মতিয়ুর রহমানের করা আবেদন।

আবেদনপত্রে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে তার পরিবারকে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ২ হাজার টাকার একটি চেকের অনুলিপি। একইসঙ্গে আবেদনপত্রে ছিল শহীদ হাফিজুর রহমানের সহযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম ও গোলাম দস্তগীর গাজী, বীর প্রতীকের সুপারিশও।

সুপারিশ প্রসঙ্গে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাফিজ ভাই ক্র্যাক প্লাটুনে আমার সহযোদ্ধা ছিলেন। তার ছোট ভাই আমার কাছে এসেছিলেন। তখন জানতে পারি তিনি তখনও স্বীকৃতি পাননি। তাই আমি সহযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশ করেছিলাম। আমি তাকে আবেদনপত্রটি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বলি। এরপর কী হয়েছে, বাকিটা জানি না। মন্ত্রণালয় থেকে আর আমাকে কখনও জিজ্ঞেসও করা হয়নি আমি তার সহযোদ্ধা কি না। তিনি যদি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পেয়ে থাকেন, তা আমাদের জন্য চূড়ান্ত লজ্জাজনক।'  

আবেদনপত্রটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এ বি তাজুল ইসলামের কাছে গেলে তিনি বঙ্গবন্ধুর চেকটি প্রমাণিত শর্তে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন। সৈয়দ মুসাদ্দেকুর রহমান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের কাছে গেলে তিনি তাকে সৈয়দ হাফিজুর রহমানের ভারত থেকে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণের সনদপত্র দেখাতে বলেন।  

কিন্তু হাফিজুর রহমান শহীদ হওয়ায় তা পরে আর কখনোই জোগাড় করা সম্ভব হয়নি বলে সেই সনদপত্র প্রদর্শনে ব্যর্থ হন মুসাদ্দেকুর রহমান। তখন তাকে আবেদনপত্র রেখে যাওয়ার জন্য বলা হয়। বলা হয়, পরে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হবে। যদিও শহীদ পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল।

সৈয়দ মুসাদ্দেকুর রহমান বর্তমানে বেলজিয়াম প্রবাসী। সম্প্রতি তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় ডেইলি স্টারের।

তিনি বলেন, 'আমি আবেদনপত্রটি নিয়ে জামুকার মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে বললেন, ''ভারত থেকে সার্টিফিকেট এনে জমা না দিলে আবেদন গৃহীত হবে না। এমন কত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার আবেদন আমাদের কাছে জমা পড়েছে। আপনি এখন রেখে যান। পরে আপনাকে জানানো হবে।'' আমি রেখে চলে এসেছি। আমার প্রশ্ন হলো, যেখানে তার সহযোদ্ধারা তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকার করছেন, যাকে টর্চার সেলে এত পৈশাচিক নির্যাতন করে হত্যা করা হলো, যার নাম স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে পর্যন্ত আছে, তিনি কেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকুও পাবেন না?'

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের তৎকালীন মহাপরিচালক সৈয়দ মাহবুব হাসানের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ভারতীয় ট্রেনিং সার্টিফিকেটটি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অন্যতম একটি শর্ত। তবে ১০ বছর আগে তখন কি হয়েছিল এতদিন পরে আমার মনে নেই। আরও কোনো জিনিস নিশ্চয়ই মিসিং ছিল। শর্তানুযায়ী পূরণ হয়নি বলেই আবেদনটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তখন এত আবেদন আসত যে, কোনটি কোন কারণে বাদ গিয়েছিল আমার পক্ষে এখন তা বলা সম্ভব না।'

২০১৩ সালে আবেদন করেছিলেন সৈয়দ হাফিজুর রহমানের ছোট ভাই সৈয়দ মুসাদ্দেকুর রহমান।

২০১৪ সালে আবারও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন শহীদ হাফিজুর রহমানের ছোট বোন সৈয়দা আনোয়ারা খাতুন। তিনি অভিযোগ করেন, মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা তাকে ঘুষের প্রস্তাবও দিয়েছেন।

আনোয়ারা খাতুন বলেন,'আমরা আবেদনপত্র নিয়ে যখন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি, তিনি আমাদের ভারতীয় ট্রেনিং সার্টিফিকেট দেখাতে বললেন। এখন আমরা তার সেই সার্টিফিকেট পাব কোথায়? মন্ত্রী জানালেন, ট্রেনিং সার্টিফিকেট ছাড়া কোনোভাবেই স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা যখন বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন মন্ত্রণালয়েরই এক লোক আমাদের বললেন ''শুধু শুধু আপনারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াচ্ছেন। জায়গামতো ৫-১০ লাখ টাকা খরচ করেন, এমনিতেই সনদ জুটে যাবে।'' দেখুন, আমরা তো ভাইয়ের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিটুকুর জন্যই গিয়েছি। এখানে টাকা-পয়সার প্রশ্নই বা কেন আসবে! আমরা কোনো ভাতা বা টাকা-পয়সা চাই না।'

ভারতীয় প্রশিক্ষণ সনদ ছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব কি না, জানতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সদস্য মেজর (অব) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

তিনি বলেন, 'শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য তার সহযোদ্ধাদের স্বীকৃতিই যথেষ্ট। ভারতীয় ট্রেনিং সার্টিফিকেট না থাকলেও কোনো সমস্যা হবে না। সবকিছু ঠিক থাকার পরও যদি তারা বাদ দিয়ে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই তা অন্যায় করেছেন।'

'এমন একজন দুঃসাহসিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না হওয়াটা ভীষণ আশ্চর্যজনক ও দুঃখজনক। সবশেষ তারা যখন আবেদন করেন, তার ৩ মাস পর আমি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে যোগ দিই। আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। জামুকার পরবর্তী বৈঠকেই পুরো বিষয়টি আমি তুলে ধরব', যোগ করেন তিনি।

 

Comments