সন্তানের প্রতিভা বিকাশে বাধা হচ্ছেন না তো

ছবি: সংগৃহীত

নবম শ্রেণি পড়ুয়া বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মৃদুল অংক পছন্দ করে না। কিন্তু, পরিবারের সবাই তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়। তাই কিছু না বলে চুপচাপ বিজ্ঞান বিভাগেই ভর্তি হতে হয় তাকে।

মৃদুলের খুব ইচ্ছে করতো 'পিংক ফ্লয়েড' কিংবা 'মহীনের ঘোড়াগুলি'র মতো গানের একটা ব্যান্ড হোক তার। ইচ্ছে করতো আইয়ুব বাচ্চু, জেমসের মত গিটার বাজিয়ে মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াতে। দর্শকের করতালি আর কোরাশে হারিয়ে ফেলবে নিজেকে। কিন্তু আশপাশের মানুষ হাসাহাসি করবে ভেবে এই স্বপ্নের কথা কখনো কাউকে বলতে পারেনি। তার পরিধি এখন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গুনগুন করা।

মৃদুলের মত কিশোরদের এমন গল্প এদেশের ঘরে ঘরে আছে। যেখানে তাদের প্রতিভা বিকশিত হওয়ার আগেই অঙ্কুরে বিনাশ ঘটে সমাজের চাপে, পরিবারের চাপে। অবাধ্য স্বপ্নগুলো বুকে পাথর চাপা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যেতে হয় জীবনে।

মনোবিজ্ঞানী ডিন কিথ সিমন্টন প্রতিভাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, 'প্রতিভা হলো এমন একটি বিষয় যা ব্যক্তির দক্ষতা অর্জনকে তরান্বিত করে এবং কোনো নির্দিষ্ট কাজের দক্ষতার বাইরেও ব্যক্তিকে ওই কাজে দ্রুত উন্নত হতে সাহায্য করে।'

অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যে কাজে অসামান্য ও অসাধারণ সেই কাজটিকেই ব্যক্তির প্রতিভা হিসেবে ধরা হয়। সুষ্ঠু বিকাশ ও সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে মানুষের নিজস্ব প্রতিভা উন্মোচিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় প্রতিভাকে মূল্যায়ন করা হয় না, অনেকে আবার প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতেও নারাজ।

উনিশ শতকের মার্কিন সাংবাদিক ব্রেন্ডা উয়েল্যান্ড বলেছেন, 'সবার প্রতিভা আছে। সবার কাছেই দেখানোর মতো কিছু না কিছু থাকে।'

প্রতিভা বিকশিত হওয়ার আগের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ব্যক্তির প্রতিভা বা তার বিশেষ আগ্রহের জায়গাটি খুঁজে বের করা। যখন কেউ নিজেকে খুঁজে পায়, নিজেকে জানতে পারে, নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে পারে, তখনই ব্যক্তি নিজের প্রতিভাকে বুঝতে পারে, চর্চা করতে শুরু করে।

ব্যক্তিভেদে প্রতিভাও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের মাঝেই কেউ আছে যারা লিখতে ভালবাসে, কেউ ছবি আঁকতে পছন্দ করে, কেউ বা গাইতে, আর কেউবা নাচতে।

অনেকে গণিতে উৎসাহী আবার কারো আগ্রহ ইতিহাসে। শিশুর প্রতিভাকে অবমূল্যায়ন করে তার ওপর নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেন অনেক অভিভাবক। পড়াশোনার বাইরে নাচ, গান, অভিনয়, খেলাধুলা বা অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার কথাই বেশি শোনা যায়।

অনেকে মনে করেন, পাঠ্যসূচি বহির্ভূত যেকোনো কর্মকাণ্ডই শিশুর ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মানুষের অভ্যন্তরীণ সুকুমার বৃত্তিগুলোই ব্যক্তিকে জীবনীশক্তি দেয়, মনের ভেতর কর্মস্পৃহা জাগিয়ে তোলে। ব্যক্তির নিজস্ব প্রতিভা তাকে কতটা জাগাতে পারে তার প্রমাণ আমরা পাই লকডাউনের সময়।

বিশ্বজুড়ে যখন করোনার মাতম, ঘরে অবরুদ্ধ মানুষ, তখন নিজের লুকোনো সত্ত্বাকেই আবার অন্বেষণ করেছে অনেকে। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই কেউ নতুন নতুন রান্না করছে, কেউ গান গাইছে, কেউ দারুণ দারুণ ছবি এঁকে নিজেদের ওয়ালে পোস্ট দিচ্ছে।

যারা নিজেদের প্রতিভাহীন ভাবতেন, তারাও ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে তাল মেলাতে নিজেকে নিয়ে ভেবেছেন, সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলে বৈশ্বিক ক্রান্তিলগ্নেও নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছেন। এই প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েই অনেকে পরবর্তীতে সফল হয়েছেন, প্রতিভাকে ক্যারিয়ারে কাজে লাগিয়েছেন। প্রতিভা যে সবসময়ই ক্যারিয়ার গঠন করবে বা করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। প্রতিভা নিজের একটা শক্তি, নিত্যকার ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে হারিয়ে না ফেলার অন্যতম নিয়ামক।

ব্যক্তির প্রতিভা চারাগাছের মতো। যাকে প্রতিদিন আলো দিয়ে, পানি দিয়ে যত্নের সঙ্গে একটু একটু করে বাড়তে দিতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়। ফল দেবে কি দেবে না এই ভেবে চারাগাছ উপরে ফেলা উচিৎ নয়। কে বলতে পারে আপনার সন্তানটি একদিন ফুটবল খেলে পেলে-ম্যারাডোনা-মেসির মতো বিশ্বখ্যাত তারকা হবে না? হয়ত ক্রিকেট খেলতে দিলে আমরা আরও কয়েকজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় পেতে পারি। বাংলাদেশের মাটিতে আইনস্টাইন জন্ম নেবে না বা নিউটন হবে না-এই ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না।

প্রতিভা বিকাশের পূর্ববর্তী ধাপ হচ্ছে নিজেকে জানা, নিজের আগ্রহ সম্পর্কে জানা। তবে শুধু প্রতিভা থাকলেই হবে না। প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রমের মিশেল এনে দিতে পারে ব্যক্তির জীবনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা।

Comments

The Daily Star  | English

Sada Pathor Looting: Admin officials, law enforcers involved

Some government officials  including members of law enforcement agencies were involved in the rampant looting of stones from Bholaganj’s Sada Pathor area, found a probe committee of the Sylhet district administration.

3h ago