ত্রিমুখী সংকটে এফ-কমার্স

ডেলিভারি পার্সনরা ঢাকা শহরের মধ্যে মূলত বাইসাইকেলে করে গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেয়। ছবি: প্রবীর দাশ

করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকে বাংলাদেশে চালু হওয়া অনেক ফেসবুক-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম বা এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। এর উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া এবং বিক্রি কমে যাওয়া।

ক্রমবর্ধমান ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে এই ফেসবুক-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলো। ফেসবুক পেজে বিভিন্ন পোস্ট বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে এবং তাদের পণ্য এবং পরিষেবা প্রচারে বুস্ট করার প্রয়োজন হয়। এর জন্য তাদের আমেরিকান গ্রিনব্যাক কিনতে এখন অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ায় কাঁচামালের দাম বেড়েছে এবং মুনাফা কমেছে।

এ বিষয়ে ওয়ারিশা ফ্যাশনের মালিক খাদিজা-তুল কুবরা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা টিকে থাকার জন্য লড়াই করছি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।'

ঢাকা-ভিত্তিক এই এফ-কমার্স প্ল্যাটফর্মটি ২০১৯ সাল থেকে মসলিন শাড়ি ও তাঁত পণ্য বিক্রি করছে। যদিও  মহামারির সময় বেশি বিক্রি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। ৩ মাস আগে যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রিও কমেছে।

খাদিজা তুল কুবরা বলেন, 'বিক্রয় ব্যাপকভাবে কমে গেছে। সুতা ও ফেব্রিক এবং ডায়িং উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। ফলে লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া দিন দিন পণ্য কিনতে গ্রাহকরা অনেক বেশি অনীহা প্রকাশ করছেন।'

এফ-কমার্সের সঙ্গে জড়িতরা জানান, ৩ মাসে এফ-কমার্সের বিক্রি গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কমেছে। খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের মধ্যে লোকজন তাদের কেনাকাটা সীমিত করেছেন। প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্যান্য পণ্য কম কিনছেন।

সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। যা গৃহস্থালির বাজেটকে সংকুচিত করেছে।

তবে পাওনা থাকা সত্ত্বেও নতুন করে এফ-কমার্স বিক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে।

অনলাইন কুরিয়ার পরিষেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পেপারফ্লাইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান বিপণন কর্মকর্তা রাহাত আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে মানুষ ফেসবুকে একটি পেজ খুলে ব্যবসা শুরু করতো। কিন্তু এখন অনেক ব্যবসায়ী যাদের দোকান আছে তারা ব্যবসা প্রসার ও বিক্রি বাড়ানোর জন্য ফেসবুক পেজ খুলছেন।'

এই উদ্যোক্তা বলেন, 'বর্তমানে ব্যবসার মন্দা অবস্থার কারণে এফ-কমার্সের প্রবৃদ্ধি কমেছে।'

তিনি ব্যবসা বাড়াতে তাদের পেজ বুস্ট করার জন্য ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিকেও দোষারোপ করেন।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাওয়ার কারণে গত এক বছরে আমেরিকান গ্রিনব্যাক টাকার বিপরীতে ২০ শতাংশেরও বেশি লাভ করেছে।

ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে এফ-কমার্স সমৃদ্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৪ মিলিয়নে পৌঁছেছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহার করে এমন দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০-এ আছে বাংলাদেশ।

সাধারণভাবে একটি পোস্ট যতসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছায়, ফেসবুকে পোস্টটি বুস্ট করা হলে তার চেয়ে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়। 

গ্যাজেট বিক্রি করা এফ-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তাজাফার্সের ব্যবস্থাপক বিপ্লব হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, 'বুস্টিংয়ের ক্রমবর্ধমান ব্যয় এখন তাদের জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয়।'

কয়েক মাস আগে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) পরিশোধের পর ১ ডলারের বিপরীতে ১০৫ টাকা থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হতো। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০-১২৫ টাকায়।

এফ-কমার্স প্ল্যাটফর্মে যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবসায়িক শনাক্তকরণ নম্বর না থাকে, তবে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অর্থ প্রদানের কারণে তাকে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়।

বিপ্লব হোসেন বলেন, 'সেক্ষেত্রে দাম ১৩৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। অনেক এফ-কমার্স প্লাটফর্মেরই এ ধরনের কোনো ব্যবসায়িক পরিচয় নম্বর নেই।'

ডিজিটাল এসএমই পার্সেল এগ্রিগেটর 'ডেলিভারি টাইগারের' প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, 'লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার জন্য প্রয়োজনীয় নগদ মার্জিনের কারণে বিলাসবহুল পণ্য বিক্রেতারা বিশেষভাবে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হচ্ছেন।'

গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসবহুল ও অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার মার্জিন যথাক্রমে ১০০ শতাংশ এবং ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। যাতে এসব পণ্যের ক্রয়কে নিরুৎসাহিত করা যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ করা যায়।

নারী উদ্যোক্তাদের ফেসবুকভিত্তিক কমিউনিটি মার্কেটপ্লেস উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পণ্যের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ছে না, যা এফ-কমার্স প্লাটফর্মের বিক্রিতে প্রভাব ফেলছে।'

তিনি বলেন, 'কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। গ্রাহকরা প্রশ্ন করছেন, কেন দাম বাড়ছে। এই বিষয়গুলো নারী উদ্যোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।'

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ই-কমার্স বিক্রি কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো- কুরিয়ার সার্ভিস, ডেলিভারি ও লজিস্টিক সার্ভিস প্রোভাইডাররা সম্প্রতি জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্য পরিবহণ বাবদ খরচ বেশি নিচ্ছেন। 

সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর পর দেশের শীর্ষ কুরিয়ার এবং লজিস্টিক পরিষেবা সরবরাহকারীরা গত আগস্ট থেকে তাদের চার্জ প্রায় ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। পেট্রল ও অকটেনের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৫১ দশমিক ১ শতাংশ এবং ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ।

একজন উদ্যোক্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু জ্বালানি বিল বৃদ্ধি নিশ্চিতভাবে ভোক্তাদের ওপরেই চাপানো হয় তাই যে আইটেমটিতে আগে ৫০০ টাকা খরচ হতো তা এখন প্রায় ৬০০ টাকা মূল্যের হবে।' 

নারী উদ্যোক্তাদের ধৈর্য ধরার এবং এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য উদ্যোক্তার মনোভাবকে ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন নাসিমা আক্তার। 

ফেসবুকের মালিকানাধীন সংস্থা মেটা গত মার্চ মাসে জানিয়েছে, মহামারির পর থেকে ফেসবুক-ভিত্তিক ব্যবসায়ের ৭০ শতাংশের মালিক নারী। নারীরা ইনস্টাগ্রামে যে ব্যবসা করে, সেখানে ৬৫ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago