দখল-দূষণে রংপুরের শ্যামাসুন্দরী খাল এখন নালা
শ্যামাসুন্দরী খাল এক সময় রংপুর শহরের লাইফলাইন ছিল। অনিয়ন্ত্রিতভাবে দখল, গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাচীনতম ও রংপুরের দীর্ঘতম এই খাল এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। যে খালটি পরিবেশ রক্ষার জন্য খনন করা হয়েছিল তা এখন পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি শ্যামসুন্দরী খাল পরিদর্শনের সময় হতাশা প্রকাশ করেছেন।
১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটি ১৮৯০ সালে খনন করা হয়। স্থানীয়দের মতে, খালটি প্রথমে ৬০ থেকে ১০০ ফুট চওড়া হলেও এখন এটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। এর পানি কালো হয়ে গেছে। সঙ্গে তীব্র দুর্গন্ধ।
স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯ শতকের শেষের দিকে মশাবাহী ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে রংপুরে অনেক লোক মারা যায়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন রংপুরের মহারানী শ্যামাসুন্দরী। মৃত্যুর পর, তার ছেলে রাজা জানকী বল্লব মশার প্রজনন মোকাবিলায় রংপুর শহরে একটি খাল খননের উদ্যোগ নেন। খালটি খনন করে তার মায়ের নামে নামকরণ করেন। সেই থেকেই খালটি রংপুরে শ্যামাসুন্দরী খাল নামে পরিচিত।
রংপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কেল্লাবন্দ এলাকায় ঘাঘট নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে পশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সিপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, পালপাড়া, গোমস্তাপাড়া, সেনপাড়া, তেতুলতলা, মুলাটোল, বৈরাগীপাড়াসহ ৩৩টি ওয়ার্ডের ১৪টির বিভিন্ন স্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই খালটি খোকসা ঘাঘট নদীতে পড়েছে। এটি রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকায় কেডি খালের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এর জল ছিল স্বচ্ছ। নগরবাসী সেখানে গোসল করতেন। কিন্তু, খালটি এখন মশা উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। এমনকি খালটি এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, শ্যামাসুন্দরী খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অনেকেই তাদের গৃহস্থালির বর্জ্য খালে ফেলে। এছাড়া অনেকে পাইপ দিয়ে সরাসরি খালে বর্জ্য ফেলে। খালের দুপাশ দখল করা হচ্ছে। ফলে খালটি সরু হয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া অনেক জায়গায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কমেছে খালের গভীরতা। খালে জমে থাকা পানি এখন মশার প্রজননের উর্বর স্থান।
অনেক জায়গায় কচুরিপানাসহ বিভিন্ন আগাছা জন্মেছে। পানি হয়ে গেছে কালো। শিল্প-কারখানার বর্জ্যও খালে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বর্ষার সময় এই খালটি রংপুর শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি বড় মাধ্যম। কিন্তু ২০২০ ও ২০২১ সালে বৃষ্টিতে রংপুর শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। স্থানীয়রা মনে করেন, যদি শ্যামাসুন্দরীর পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা যেত, তাহলে এই জলাবদ্ধতা রংপুর শহরে দেখা যেত না।
২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে রংপুর সিটি করপোরেশন খালটির দুপাশ থেকে দখল উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
রংপুরের ডিসি কার্যালয় ৪৪৩ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছিল। গত ১৫ বছরে দখলকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ ও ২০১৩ সালে দখল উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শতভাগ সম্ভব হয়নি। পরবর্তী বছরগুলোতে খাল সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
খালটি সংস্কারে ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও ওই তহবিলের ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রংপুরের সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি অধ্যাপক ফখরুল আনাম বলেন, 'মাস্টারপ্ল্যানের অভাবে ঐতিহাসিক শ্যামাসুন্দরী খালটি ল্যান্ডফিলে পরিণত হয়েছে।'
তিনি অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনিয়ন্ত্রিত দখলের জন্য এটি এখন একটি নালা। স্থানীয় প্রশাসন দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। খালের পাশ দিয়ে কেউ হাঁটলে দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না।
রংপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, তারা খালটির সম্ভাব্যতা যাচাই করছে।
রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, খালটি সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের ব্যবস্থা করে তিনি নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শাম্যাসুন্দরী খাল আর খাল নেই। এখন একটি নালা। দখলদারদের দৌরাত্ম ও বর্জ্য ফেলার কারণে এমনটি হয়েছে।
'নদী বা খাল যেকোনো স্থানের একটি প্রাণ। রাষ্ট্রকে এর আসল আকৃতি রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে,' তিনি যোগ করেন।
Comments