সুইজারল্যান্ডের শিশুশিক্ষা ব্যবস্থা ও বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত

সম্প্রতি জুরিখে একটি শিশু স্কুলে যাওয়ার পথে জেব্রা ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। জুরিখসহ গোটা সুইজারল্যান্ডের মানুষ শোকে স্তম্ভিত হয়ে আছে এ ঘটনায়। শিক্ষার অধিকার যথাযথভাবে সুইস শিশুরা পাচ্ছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে এখন।
স্টার ফাইল ফটো

সম্প্রতি জুরিখে একটি শিশু স্কুলে যাওয়ার পথে জেব্রা ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। জুরিখসহ গোটা সুইজারল্যান্ডের মানুষ শোকে স্তম্ভিত হয়ে আছে এ ঘটনায়। শিক্ষার অধিকার যথাযথভাবে সুইস শিশুরা পাচ্ছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে এখন। 

স্কুলের যাতায়াত পথটি হতে হবে নিকটতম দূরত্বের, হতে হবে নিরাপদ এবং বিপদমুক্ত—এটাই বলছে সুইস সংবিধান। শিশুটি মারা গেলে স্কুলে যাতায়াতের পথে। এ ক্ষেত্রে কি বিষয়টি সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে? 

স্কুল কর্তৃপক্ষ কি শিক্ষার্থীদের স্কুলের যাতায়াতের পথটি নিরাপদ করতে বা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন? এমন প্রশ্ন রেখেই এখন আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। স্কুলে শিশুদের না পাঠালে সেটা অন্যায় এবং অপরাধ। তারপরও দেশে প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া শুরু করার পরই শিশুদের একাংশ শুধু দারিদ্র্যের কারণেই স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। যেটাকে বলা হয় 'ঝরে পড়া'।

প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার প্রসঙ্গে সুইস সংবিধান কী বলছে, সে প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। বলা হচ্ছে, 'যদি স্কুলে যাওয়ার পথ খুব দূরে বা খুব বিপজ্জনক হয় এবং সেই পথ যদি নিরাপদ  না হয় বা সময়মতো স্কুলে পৌঁছানো না যায়, তাহলে শিক্ষার অধিকার লঙ্ঘিত হয়।'

জুরিখের ২টি ঘটনার এবং বাংলাদেশের একটি গ্রামের উদাহরণ টানব এই লেখাতে।

এ সপ্তাহের যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেছি, তা ঘটেছে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসবাসের স্থান থেকে মাত্র ৫ মিনিট দূরত্বে। এসারভিসপ্লাসে এক পথচারী ৫ বছরের শিশুটিকে সকাল ৮টার দিকে মৃত পড়ে থাকতে দেখেন। পুলিশ গিয়ে বুঝতে পারে যে ট্রাক বা প্রাইভেট গাড়ির আঘাতে শিশুটি মারা গেছে। পুলিশ এখন সব চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কে অপরাধী তা তদন্ত এবং মামলা শেষ হলে জানা যাবে।

শিশুটি পায়ে হেঁটে একাই কিন্ডারগার্টেনে যাচ্ছিল। গত এক বছর বাবা-মা সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন, বাড়ি নিয়ে আসতেন। পরে সে নিজেই যাওয়া-আসা শিখে যায়। 
শিশুটি আমাদের বন্ধুর মেয়ে ইয়াসনার সহপাঠীর ছোট ভাই। ইয়াসনা এবং তার সহপাঠীর বয়স ১০। খুব ভাল বেহালা বাজায় ওরা। আমি একদিন স্কুল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে ওদের দিয়ে রাস্তায় স্টেশনের পাশেই বেহালা বাজাতে অনুরোধ করেছিলাম। ওরা খুব চমৎকার বাজাল, আমি ভিডিও করেছিলাম। ২ জনকে ২০ ফ্রাংক বকশিস দিয়েছিলাম। কতই না খুশি হয়েছিল ওরা! এমন একটি ঘটনায় আমাদের ছোট্ট ইয়াসনাও ওর সহপাঠীর মতো স্তব্ধ হয়ে আছে। কান্না বন্ধ করতে পারছে না মেয়েটা।

শোক ছড়িয়ে পড়েছে সবার মধ্যেই। দুর্ঘটনাস্থলে প্রতিদিন ফুল আর মোমবাতি নিয়ে শোক জানাতে ভিড় করছেন শত শত মানুষ। স্কুলে যাওয়ার পথে ৫ বছরের এই শিশুটির মৃত্যু নিয়ে এখন তোলপাড় শুধু জুরিখ নয়, সারা সুইজারল্যান্ডে। বড়দিনের খবর ছাড়িয়ে প্রতিদিন গণমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে এই শিশুটির মৃ্ত্যু এবং শিক্ষার অধিকার। 

প্রশ্ন উঠছে, স্কুলে যাওয়ার এই পথটি শিশুদের জন্য নিরাপদ ছিল কি না। স্কুলের পথটি যদি শিশুদের যাতায়াতে অনিরাপদ প্রমাণিত হয় তবে বিষয়টি হবে সংবিধান লঙ্ঘন, শিক্ষার অধিকার লঙ্ঘন।

এবার আসা যাক গত সপ্তাহের একটি ঘটনায়। জুরিখের অভিজাত এলাকা জুরিখ লেকের পাদদেশের পৌরসভা ওয়েডেন্সউইলের ঘটনা এটি। সেখানে একটি পরিবার তার ৬ বছরের শিশুকে পাঠান তাদের বাসা থেকে ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার দূরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। 

শিশুটির অভিভাবকের দাবি, এই পথ এই ছোট শিশুর পক্ষে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে সংবিধান লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তাই বিষয়টি নিয়ে সাংবিধানিক সুরক্ষা চেয়ে আদালতে মামলা করেন শিশুটির বাবা-মা। এই মামলা নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

এখানে একটু বলে নিতে হয়। সুইস প্রাথমিক শিক্ষা আইনে কোন শিশুটি প্রথমদিন কোন স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে যাবে সেটা নির্ধারিত হয় শিক্ষা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। 

শিশুর বাড়ির আশেপাশের স্কুলটি থেকেই সাধারণত অভিভাবকরা শিশু ভর্তির বাধ্যতামূলক আমন্ত্রণপত্র পেয়ে থাকেন। অভিভাবক ওই স্কুলেই নির্দিষ্ট দিন বা সময়ে শিশুটিকে ভর্তি করতে বাধ্য। চাইলেই কোনো অভিভাবক তার শিশুকে নিজের ইচ্ছে বা সুবিধামতো কোনো স্কুলে ভর্তি করাতে পারবেন না। সুইস সংবিধান সেটির অনুমোদন দেয় না।

আমার সন্তানকে আমি আমার ইচ্ছেমতো পড়াশুনা করাব, গাড়িতে করে সকাল বেলা স্কুলে নিয়ে যাব, অফিসের পাশে বলে কোনো স্কুলে ভর্তির সুবিধা নেব—এমন সব দাবি করে কোনো শিশুকে নিজের পছন্দের স্কুলে ভর্তি করার সুযোগ সুইস শিক্ষা আইন দেয় না কাউকে।

স্কুল প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে বাতিল করানো সম্ভব নয়, হোক শিশুটি কোনো বিচারপতি বা রাজনৈতিক নেতা বা দেশের শীর্ষ ধনীর সন্তান। উচ্চ শিক্ষা মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মেধার ওপর নির্ভর করে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আলাদা করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ এখানে থাকে না।

স্কুলে যাতায়াতের পথ একটু দূর বলে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলার বিষয়টিতে ফেরা যাক। বাসা স্কুল থেকে দূর হওয়ার পাশাপাশি আরেকটি অভিযোগ শিশুটির বাবা-মায়ের ছিল। তা হলো, যে স্কুলটিতে তাদের শিশু সন্তানকে ভর্তি করানো হয়েছে সেখানে অধিকাংশ শিশুর অভিভাবক বিদেশি। ওই শিশুদের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের ওই শিশু ভাষা ও সংস্কৃতিতে খাপ খাওয়াতে পারছিল না। তাই তারা মামলায় তাদের শিশু সন্তানকে অন্য স্কুলে ভর্তির অনুমোদন চান।

তারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত 'স্কুলে যাওয়ার যুক্তিসঙ্গত উপায়ের অধিকার' যুক্তি উল্লেখ করেন। 'যুক্তিসঙ্গতের' মানদণ্ড হচ্ছে পথের দৈর্ঘ্য, অবস্থা, উচ্চতার পার্থক্য এবং বিপদের পাশাপাশি শিশুর বয়স এবং সংবিধান। এই যুক্তিতে শিশুটির অভিভাবকরা আরও একটি বিষয় তাদের মামলায় উল্লেখ করেছিলেন। তা হলো, যাতায়াতের পথটি দূরে হওয়ার কারণে তাদের সন্তান বাড়িতে দুপুরের খাবারের জন্য পর্যাপ্ত সময় পায় না। বাধ্য হয় ক্লাসের পরে পরিচর্যা কেন্দ্রে খেতে।

অভিভাবকরা আরও দাবি করেন, বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব হওয়া উচিত ১ হাজার ৩০০ মিটারের পরিবর্তে ৮৫০ মিটারের মধ্যে। কারণ সুইজারল্যান্ডের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সাধারণত ৮৫০ মিটার দূরত্বের মধ্যেই অবস্থিত। এই স্কুলটি সেই আনুপাতিক হারে তাদের শিশু সন্তানের জন্য একটু দূরে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের ওই দাবির সঙ্গে একমত হতে পারেনি।

জেলা পরিষদ গত আগস্টে শিশুর বাবা-মায়ের আপিল খারিজ করে দেয়। প্রশাসনিক আদালতও তাদের রায়ে বলেন, ওই শিশুর জন্য স্কুলে যাওয়া আসার পথ খুব দীর্ঘ নয় এবং পথটি যাতায়াতের ক্ষেত্রে নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ।

আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেন, ঘণ্টায় যদি একটা শিশু ৩ কিলোমিটার পথ হাঁটতে পারে তবে ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার যেতে শিশুটির দরকার পড়বে ২৬ মিনিট সময়। স্কুলে যেতে এই সময়কাল যুক্তিসঙ্গত। সংবিধান এতটুকু হাঁটা এবং সময় অনুমোদন করে। এটি বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্যও যথেষ্ট সময়। পথও বিশেষ বিপজ্জনক নয়।

স্কুলে বিদেশিদের বাচ্চা বেশি থাকার যুক্তিও খারিজ করে দেন আদালত। তাই অভিভাবকদের মামলা খারিজ হয়ে যায়। রায় চূড়ান্ত হয়। নিম্ন এবং উচ্চ উভয় আদালতেই শিশুটির অভিভাবক মামলায় হেরে যান। শিশুটিকে সরকার নির্ধারিত স্কুলে ওই পথটুকু পায়ে হেঁটেই স্কুলে যেতে হবে এখন।

এবার আসা যাক বাংলাদেশের একটি স্কুলে শিশুরা কীভাবে যাতায়াত করে সে প্রসঙ্গে। স্কুলটির নাম জালালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এবার অক্টোবরে ছুটির সময় গিয়ে আমি বিষয়টি লক্ষ্য করি। একটি ভিডিও বানাই।

প্রায় ২০০ শিশু একটি বড় নদী পার হয়ে স্কুলটিতে পড়াশুনা করতে যায়। স্কুলে পৌঁছাতে তাদের সময় লাগে অন্তত দেড় ঘণ্টা। নদীর পাড় দিয়ে বিপজ্জনক পথে তাদের হাঁটতে হয়। 

এই ২০০ শিক্ষার্থীর নদী পারাপারের কোনো ব্যবস্থা স্কুল কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় প্রশাসন কেউ নেয়নি। এমনকি ওই পথে একটি খেয়া নৌকাও নেই। অভিভাবকরা যে যার মতো সন্তানকে নিজের অথবা অন্যের নৌকা দিয়ে স্কুলের পথে নদী পারাপার করে দিয়ে থাকেন। অধিকাংশ অভিভাবক খেটে খাওয়া মানুষ।

তাদের অনেকেই বলেছেন, কাজে যাওয়ার কারণে সন্তানকে অনেক সময় স্কুলের ২ ঘণ্টা আগেই নদী পার করে দিয়ে আসেন তারা। সবচেয়ে বেশি সমস্যা বর্ষাকালে। নদী তখন উত্তাল থাকে, বড় ঢেউ থাকে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই স্কুলে যেতে হয় শিশুদের। তাদের কারো স্কুলব্যাগও নেই। এক সেট শুকনো কাপড় তাই পোটলায় করেই নিয়ে যেতে বইখাতার সঙ্গে।

প্রশ্ন এখন শিক্ষার অধিকার নিয়ে। কতটুকু অধিকার আসলে পাচ্ছে আমাদের শিশুরা? সংবিধান অধিকার দিয়ে রেখেছে, কিন্তু সংবিধান পালনকর্তারা তথা যারা সংবিধান পালনের জন্য শপথ নিয়ে দায়িত্বে আছেন তারা কি তা বোঝেন বা পালন করেন?

সুইজারল্যান্ডের স্কি এলাকার রাজনীতিবিদের একটা উদাহরণ দেবো এখন। শীতের স্কি খেলার মৌসুমি টিকিট উপহার পেয়েছিলেন ওই এলাকার রাজনীতিবিদরা। এই মৌসুমি টিকিটের দাম প্রায় ৮৫০ সুইস ফ্রাংক। এমন উপহারের বিষয়টি এখন সমালোচনা তুঙ্গে। এটিকে বলা হচ্ছে অনৈতিক এবং ঘুষ নেওয়ার মতো অপরাধ।

অনেক রাজনীতিবিদ এই উপহার প্রত্যাখ্যান করেছেন, আবার অনেকে গ্রহণ করেছেন। যারা গ্রহণ করেছেন তাদেরকে বলা হচ্ছে লোভী। মাত্র ৮৫০ ফ্রাংক উপহার নিয়ে তারা অনৈতিক কাজ করেছেন—এমন অভিযোগ আসছে। এর আগে এমন ঘটনায় এক শীর্ষ নেতাকে আদালতে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। উপহারের অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগার ফেরত দিতে হয়েছিল। আদালত বলেছিলেন, রাজনীতিবিদরা কি সংবিধান জানেন না? পড়েন না? আইন না জেনে বা সংবিধান নিয়ে পড়াশুনা না করে রাজনীতি করা, পদে থাকাটা অন্যায়। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা।

এমন অপরাধী আর প্রতারকের কি অভাব আছে আমাদের আশেপাশে?

সুইস স্কুলগুলোতে আগামী ১০ বছরে ৭৫ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। ফেডারেল পরিসংখ্যান অফিসের অনুমান, স্কুলগুলোতে ২০৩১ সালের মধ্যে ৬ শতাংশ শিক্ষক সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রাথমিক স্তরের জন্য ৪৩ হাজার থেকে ৪৭ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, মাধ্যমিক স্তরের জন্য নতুন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে ২৬ হাজার থেকে ২৯ হাজার। এর কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি।

২০৩১ সালের মধ্যে কত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে সে পরিকল্পনা এখনই তারা হাতে নিয়ে রেখেছে। সুইজারল্যান্ডের মোট জনসংখ্যা ৮৬ লাখ। এবার ধরেই নিতে পারেন তাদের প্রজন্মের শিক্ষার জন্য শিক্ষকের সংখ্যা কত?

একটা প্রশ্ন কিন্তু এখন করেই রাখা যায়। ২০৩১ সালে সুইস জনসংখ্যা তাহলে কত বাড়বে? একই বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে কত?

সুইজারল্যান্ড আগামী ২০৩১ সালের শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী ভাবছে সেই প্রশ্ন করাটা কি একটু বেশি ইউটোপিয় হবে? ধনী হওয়ার দিক থেকে যদি সিঙ্গাপুর হই তবে শিক্ষার যুক্তিতে কেন আমরা ইউটোপিয়?

শেষে একটি তথ্য জানানো দরকার। সুইজারল্যান্ডসহ উন্নত দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা একজন পাইলটের বেতন ভাতার প্রায় কাছাকাছি। এটা সবারই জানা। এর কারণটা কী? প্রাথমিক শিক্ষকদের কেন তারা এত বেতন-ভাতা দিয়ে থাকেন?

কারণ প্রাথমিকের শিক্ষায় আসেন দেশটির মেধাবীরা। তাদেরকে মনোবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, গণিত, গান, সংস্কৃতি, ভাষা, খেলাধুলা সব বিষয়ে সনদ নিতে হয়। আমার সন্তানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের এসব সনদের পরেও বাড়তি একটি সনদ ছিল বিমান চালনার। অর্থাৎ সে পাইলটও।

অথচ বাংলাদেশে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অবহেলিত ছিল এবং আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। ঢাকা শহরে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যে বেতন-ভাতা পান, তা দিয়ে ২ রুমের একটা বাসাও ভাড়া নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি চলবেন কীভাবে? পেটে ভাত নেই, ছাত্র পড়িয়ে মানুষ তিনি বানাবেন কীভাবে?

'ম্যাডাম গীতা রানি' নামের একটি সিনেমা আছে। সিনেমায় দেখানো হয়, পাস করতে পারেনি বলে শিক্ষার্থীদের একটা অংশকে শিক্ষকরা ওপরের ক্লাসে প্রমোশন দেননি। ওরা ঝরে পড়েছে। বিভিন্ন কাজে লেগে গেছে। ওদের একটা অংশ অপরাধী হয়ে যায়।

স্কুলে যদি শিক্ষা দেওয়া যেত তবে ওরা অপরাধী হতো না। ম্যাডাম গীতা রানি ওই ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনেন। তাদের শিক্ষা দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে জেলা পরিষদে প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানে নিয়ে আসেন। এই সিনেমা মোটেই ইউটোপিয় নয়, এটাই বাস্তব।

বাস্তবেও দেশের সব শিশুকে আদর্শ শিক্ষার আওতায় আনতে পারলে দেশে আর অপরাধী তৈরি হতো না। বাংলাদেশে যে টাকা অপরাধ দমনে ব্যয় করা হয়, তা শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ বা ব্যয় করলে এবং সংবিধান অনুযায়ী সবার কথা ভাবলে অপরাধই দেশে থাকত না।

টাকাওয়ালাদের লুটপাটের অপরাধ আবার ভিন্ন বিষয়। এমন বড় অপরাধ তো দেশে এখন অন্যায় নয়, বরং ব্যবসা। এক মন্ত্রী বছর তিনেক আগে জুরিখের একটি অনুষ্ঠানে হুন্ডি নিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, 'হুন্ডিও তো একটা ব্যবসা।'

যাই হোক, আলোচনা শিক্ষার অধিকার নিয়েই করলাম। ৩টা উদাহরণ টানলাম। ২টি জুরিখের ঘটনা এবং ১টি বাংলাদেশের। পাঠকরাই বিচারক। বিচার করবেন, শিক্ষার অধিকার বিষয়ে আপনি-আমি কতটা জানি? কতটা জানা উচিত?

লেখক: সুইজারল্যান্ডপ্রবাসী।

Comments

The Daily Star  | English
quota reform movement,

Govt publishes preliminary list of those killed in July-August protests

The interim government today published a preliminary list of 726 people who died during the student-led mass protests in July and August.

1h ago