টেক বিলিয়নিয়ারদের দুর্ভাগ্যের বছর ২০২২

টেক বিলিয়নিয়ারদের দুর্ভাগ্যের বছর ২০২২
ছবিধ সংগৃহীত

২০২২ সালকে বিশ্বের ধনিক শ্রেণির জন্য দুর্ভাগ্যের বছর বললেও ভুল হবে না। এই বছর বৈশ্বিক বিলিয়নিয়ার গোষ্ঠীর হারানো সম্পদের মোট পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

তবে বছরটিতে সবচেয়ে জোরালো আর্থিক ধাক্কা লেগেছে টেক কোম্পানি ও মালিকদের ব্যক্তিগত সম্পদে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক টেক বিলিয়নিয়ররাই ২০২২ সালে মোট ৩১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সম্পদ হারিয়েছেন। 

তবে, সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন টেসলা মালিক ইলন মাস্ক। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, বছর শেষে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সম্পদ হারিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর আসনটিও হাতছাড়া হয়েছে মাস্কের। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ফ্রেঞ্চ-ভিত্তিক ফ্যাশন জায়ান্ট লুই ভিতোর মালিক বার্নার্ড আর্নল্ট। 

শুধু মাস্কই নয়, সম্পদ হারানোর তালিকায় মেটা ও তার প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ, গুগল এর সার্গেই ব্রেইন ও ল্যারি পেজ, মাইক্রোসফটের বিল গেটস, আমাজনের জেফ বেজোস, এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিন্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা চ্যাংপেং ঝাওসহ আরও অনেকে।  
 
বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ধনী ফ্রেঞ্চ-ভিত্তিক ফ্যাশন জায়ান্ট লুই ভিতোর মালিক বার্নার্ড আর্নল্ট। ছবি: ফোর্বস

প্রযুক্তিখাতে ২০২২ সাল

বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভক্স জানায়, প্রযুক্তি খাতে কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম বড় ধাক্কাটা খেয়েছে নেটফ্লিক্স, শেয়ার বাজারে ৬০ শতাংশের বেশি সম্পদ হারায় প্রতিষ্ঠানটি। শতকরা ৫৮ ভাগ শেয়ারমূল্যে পতন দেখেছে ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা। গুগল ফাইন্যান্সের মতে, ২০২২ প্রায় ৩০ শতাংশ দরপতন দেখেছে গুগল ও আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠান। চলুন দেখে নেওয়া যাক, বিদায়ী বছরটা যে ৫ টেক বিলিনিয়রদের জন্যে ছিল দুঃস্বপ্ন।

ইলন মাস্ক

ইলন মাস্কের কাছে ২০২২ সালটা ছিল সংবাদের শিরোনাম হবার জন্যে দারুণ একটি বছর, তবে সম্পদের দিকে তাকালে মাস্কের জন্যে বছরটি মোটেও ভালো ছিল না। টুইটার বিতর্ক, টেসলার শেয়ার বিক্রিসহ নানা কারণে মাস্কের সম্পদে চরম পতন দেখা যায়। বছরজুড়ে লেগে থাকা টুইটার বিতর্ক বন্ধে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ইতিহাসের ব্যয়বহুল চুক্তিটি সম্পন্ন করেন মাস্ক। অধিগ্রহণ চুক্তি থেকে পেছনে হটার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও আদালতের নির্দেশে ফেঁসে যান তিনি। 

বিজনেস ইনসাইডারের এক তথ্যসূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারির মধ্যেও মাস্কের সম্পদ বেড়েছিল রেকর্ড পরিমাণ, ২০২১ সালের নভেম্বরে যা ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ঠেকেছিল। ব্লুমবার্গের ২৫ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, সেরা ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে চলে যাওয়া মাস্কের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ১৩৯ বিলিয়ন ডলার। শুধু ব্যক্তি-সম্পদ নয়, টেসলা, স্পেস-এক্সসহ মাস্কের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দরপতন হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয় সাইট টুইটার নিয়ে তার অতি আগ্রহের খেসারত দিতে হয়েছে নিজ প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। ইলেক্ট্রনিক যানবাহন ও মহাকাশ বাণিজ্যে রমরমা ব্যবসা করা মাস্ক টুইটারে ঝড় তোলার খেসারত হিসেবে শীর্ষ ধনীর মুকুট হারিয়েছেন। এত নাটকীয়তা পরে টুইটারের যে আসনটি দখল করেছিলেন, এখন সেই আসনটি থেকে সম্প্রতি সরে যাওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন নিজেই। 

মার্ক জাকারবার্গ 

চলতি শতকের শুরুতে প্রযুক্তি-বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করা কয়েকটি আবিষ্কার ছিল ঐতিহাসিক পর্যায়ের, যার মধ্যে ফেসবুক থাকবে শীর্ষ পর্যায়ে। সম্পদের তালিকাতেও শীর্ষে থাকা এই প্রযুক্তি দানবের জন্যে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মোটেও অনুকূলে ছিল না। প্রাইভেসি, নিরাপত্তা ঝুঁকি, সন্ত্রাসবাদ ও নির্বাচনে প্রভাব রাখা নিয়ে নানান বিতর্কে গেল কয়েক বছর খুব খারাপ যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিহাসে পথিকৃৎ ফেসবুক ও তার প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকার্বাগের জন্যে। তবে, ২০২২ সালটা মেটা ও জাকারবার্গের জন্য মোটা দাগে ক্ষতির একটি বছর।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মেটার শেয়ার মূল্য ৫৭ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। অর্ধেকে নেমে এসেছে প্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গের সম্পদ, ছিটকে গেছেন শীর্ষ ১০ ধনীর তালিকা থেকেও। এমন ধসের পেছনে মুখ্য ভূমিকায় ছিল শেয়ার মূল্য কমে যাওয়া, অ্যাপলের প্রাইভেসি পলিসিতে পরিবর্তন এবং চীনা মাধ্যম টিকটকের উত্থান।   

চ্যাংপেং ঝাও

অনেকের কাছেই নামটি অপরিচিত, কারণ পরিচিত হবার আগেই হারিয়ে যেতে বসেছেন ঝড়ের বেগে বিলিয়নিয়র হওয়া চীনা-কানাডীয় এই উদ্যোক্তা। ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ক্রিপ্টো-কারেন্সি। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির এই নব্য-দুনিয়ায় ঝাও পরিচিত একজন অগ্রপথিক হিসেবে। মাত্র ৫ বছর আগে, ২০১৭ সালে চীনা বংশোদ্ভূত চ্যাংপেং ঝাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী ক্রিপ্টো-কারেন্সি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি 'বিনান্স'।

অন্যসব প্রযুক্তি বিলিয়নিয়ারদের মতো চীনা ক্রিপ্টো সম্রাট হিসেবে পরিচিত ঝাও এর জন্যেও ২০২২ সালটা ছিল দুঃসময়। ২০২১ সালের জুলাইতে ৯৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে শীর্ষ বিলিনিয়রদের পাশে ঠাই করে নিয়েছিল চীনের জিয়াংশু প্রদেশে জন্ম নেওয়া ঝাও। তবে, ক্রিপ্টো প্রিসেল অনুযায়ী বিদায়ী বছরে ঝাও তার সম্পদ হারিয়েছেন প্রায় ৮৫ ভাগ। টাকার অর্থের তার হারানো সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার সম্পদ হারানোর পেছনে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, বিটকয়েনের তুলনায় মার্কিন ডলারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এবং ক্রিপ্টো-ধস অন্যতম।

জেফ বেজোস

ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মহামারিতে ধুন্ধুমার ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন বেজোস। ২০২১ সালে তার ব্যক্তি-সম্পদের পরিমাণ ছাড়িয়ে গিয়েছিল ২০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। ২০২২ সালে এসে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর মুকুট হারানোর পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ সম্পদ হারান ই-কমার্স জায়ান্ট আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। 

ব্লুমবার্গের ২৫ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ সম্পদশালীদের তালিকায় বেজোসের অবস্থান পঞ্চম। তার সম্পদের পরিমাণ ১০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্টের বরাতে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বেজোসের হারানোর সম্পদের পরিমাণ ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলমান অর্থনৈতিক সংকট, নির্বাহী পদ থেকে সরে যাওয়ার পাশাপাশি তার সম্পদ কমার পেছনে এক অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। তার সাবেক স্ত্রী ম্যাকেঞ্জির সঙ্গে এই বিচ্ছেদের ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ৩৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে।
 

বিল গেটস

বিশ্বের সাবেক ধনী ও মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের জন্যেও ২০২২ সাল খুব একটা সহায়ক ছিল না। তবে, অন্যদের সঙ্গে তার সম্পদ হারানোর মধ্যে কিছুটা তফাৎ আছে। অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি গেটসের সম্পদ হ্রাসের পেছনে ভূমিকা রয়েছে দাতব্যের মতো এক মহৎ কাজেরও। বরাবর জনকল্যাণমূলক দানের জন্য খ্যাতি লাভ করেছেন গেটস দম্পতি। 
 
বিবিসির তথ্যসূত্রে, গেটস দম্পতি তাদের নামে গড়া বিশ্বের প্রভাবশালী দাতব্য সংস্থা বিল এবং মেলিন্ডা গেটসে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করার ঘোষণা দেন। শুধু তাই নয়, বিদায়ী বছরের জুলাইতে গেটস টুইটের মাধ্যমে তার সব সম্পদের দানের ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'আমি কার্যত আমার সমস্ত সম্পদ ফাউন্ডেশনে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। আমি ধনাঢ্য ব্যক্তি-তালিকার নিচে চলে যাব এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকা থেকে বাদ পড়ব।'
 
তার এমন ঘোষণার প্রমাণও মেলে চলতি বছরে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের তথ্যসূত্রে, বিদায়ী বছরে বিল গেটসের সম্পদ হ্রাস পেয়েছে ২৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্লুমবার্গের ২৫ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, চতুর্থ অবস্থানে থাকা গেটসের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ১০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

 

তথ্যসূত্র: ব্লুমবার্গ, দ্য গার্ডিয়ান, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, সিএনবিসি, ফোর্বস, ভক্স

 

Comments

The Daily Star  | English

US lowers Bangladesh tariff to 35% from 37%

Failure to secure a more favourable bilateral agreement by the Aug 1 deadline would be a significant blow to the country's export-oriented economy

3h ago