উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির তুলনা

কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির তুলনা

সাম্প্রতিক সময়ে আবারো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে কোরিয়ার উপদ্বীপে। কারণ আর কিছুই নয়। উত্তর ও দক্ষিণ—২ কোরিয়াই বেশ কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা করেছে।

২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া জানিয়েছিল, তারা কৌশলগত কারণে দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। এটি ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে সফলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।

এর ৩ দিন পর, উভয় দেশই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে। সেই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পারমাণবিক 'ওয়্যারহেড' বহনে সক্ষম।

২ কোরিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা আজকের নয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে বিভক্ত করে দেয় কোরীয় উপদ্বীপকে। সেসময় এটি জাপানের শাসনাধীনে ছিল।

জাপানি শাসনমুক্ত হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে উদ্যোগী হয়।

১৯৫০ সালে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরোক্ষ সহায়তায় উত্তর কোরিয়া প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়াকে আক্রমণ করে। শুরু হয় কোরীয় যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র সেই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩ বছর ধরে চলা নেই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সহায়তা করেছিল।

যুদ্ধ বন্ধে রাজি হলেও ২ দেশের মধ্যে শান্তি চুক্তি সই হয়নি।

মুখোমুখি সামরিক বাহিনী

২ কোরিয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র‍্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্যানুসারে, উত্তর কোরিয়ার আছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনী। এর সদস্য সংখ্যা ১০ লাখ ২৮ হাজার।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের দেশ উত্তর কোরিয়ার জিডিপির প্রায় এক চতুর্থাংশ সামরিক বাহিনীর পেছনে খরচ হয়। এটি বিশ্বে সর্বোচ্চ।

দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীতে আছে ৬ লাখের মতো সেনা। আকারে উত্তর কোরিয়ার অর্ধেক। দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭৩ বেস ক্যাম্পে ২৬ হাজার ৪০০ মার্কিন সেনা আছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি 'ক্যাম্প হাম্ফ্রেস' ২ কোরিয়ার সীমান্তে বেসামরিক স্থান (ডিএমজি) হিসেবে পরিচিত 'বাফার' এলাকা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে।

'স্পেশাল মেজারস অ্যাগ্রিমেন্টের অংশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রকে এক বিলিয়ন ডলার দেয়। এর ফলে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে।

উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি

সেন্টার ফর স্ট্র‍্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের তথ্যানুসারে, ১৯৮৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া ১৫০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে।

এর মধ্যে আছে স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোর পরিসর এক হাজার কিলোমিটারের কম। এ ছাড়াও আছে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোর পরিসর ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত পারমাণবিক 'ওয়্যারহেড' বহনে ব্যবহৃত হয়।

এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার হয়েছে গত ১০ বছরে কিম জং উনের নেতৃত্বে। তিনি ২০১১ সালে বাবা কিম জং ইলের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন।

৩৮ বছর বয়সী কিম যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করেছেন। যুদ্ধাস্ত্র তৈরি চালিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তিনি বাইডেন প্রশাসনের সংলাপে বসার আহ্বান 'উড়িয়ে' দিয়েছেন। তার দাবি, ওয়াশিংটন যেন এর আগে তাদের বৈরিতাপূর্ণ নীতিমালাগুলো সংশোধন করে।

প্রতি বছর উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরিসর বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে দেশটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র 'হোয়াসং-১৫' পরীক্ষা করে। এর পরিসর ১২ হাজার ৮৭৪ কিলোমিটার ও আমেরিকা মহাদেশের যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি

২০০৩ সালে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা চুক্তি থেকে সরে আসে। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে হওয়া চুক্তি, সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ও এ সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।

এর ৩ বছর পর কিম জং ইলের নেতৃত্বে দেশটি তাদের পাঙ্গেইরি পারমাণবিক ভূগর্ভস্থ কেন্দ্রে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে। পিয়ংইয়ং এ পর্যন্ত ৬ বার পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর কোরিয়া ১৪০ কিলোটনেরও বেশি ওজনের হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষা করেছে বলে জানা গেছে।

২০২১ সালের আগস্টে জাতিসংঘের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, উত্তর কোরিয়া এমন একটি পারমাণবিক রিঅ্যাকটর চালু করেছে যা পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করে থাকতে পারে।

পিয়ংইয়ং ২০০৯ সালে এই সংস্থার পর্যবেক্ষকদের দেশ থেকে বের করে দেওয়ার পর থেকে সেখানে আইএইএর কোনো পর্যবেক্ষক নেই৷

এতসব নিষিদ্ধ পারমাণবিক অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে অব্যাহতভাবে কাজ করার কারণে উত্তর কোরিয়া এখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় আছে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর ধারণা, উত্তর কোরিয়ার ২০-৬০টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি

এসব ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়েই দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির ওপরই নির্ভরশীল। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনা হয় না।

দক্ষিণ কোরিয়ার 'হায়েসিয়ং ১' খুব স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। এর দ্বিতীয় সংস্করণটির পরিসর ৫০০ কিলোমিটার। 'হায়েসিয়ং ৩'র পরিসর ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার।

সিউলের 'হিউনমো' সিরিজের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অপেক্ষাকৃত উন্নত হলেও সেগুলোও স্বল্পপাল্লার (হিউনমো ২ বি ৫০০ কিলোমিটার ও ২ সি ৮০০ কিলোমিটার)।

'হিউনমো-৩' সি সবচেয়ে উন্নত হলেও এটিও ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে আঘাত হানতে পারে না।

ক্যাটো ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ড্যুগ বানডোর মতে, ২০২৭ সাল নাগাদ উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্রখাতে আরও শক্তি অর্জন করবে। তখন দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পড়বে। ফলে, সিউলের জন্য সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হবে মনে করেন তিনি।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্স, মিলিটারি স্ট্রেন্থ, ন্যাশনাল টাইমস, মিলিটারি থ্রেট, ক্যাটো ইনস্টিটিউট

Comments

The Daily Star  | English

Govt calls for patience as it discusses AL issue with parties

Taken the initiative to introduce necessary amendments to the ICT Act, says govt

38m ago