৩ কিলোমিটার রেললাইন যেন মৃত্যুফাঁদ, এক বছরে ১৬ মৃত্যু

ট্রেনের কাটা পড়ে মৃত্যু
নীলফামারীর সৈয়দপুরে স্টেশনপাড়ায় রেললাইনের ওপর চলছে পুরনো কাপড়ের বেচাকেনা। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

আইন মোতাবেক রেললাইনের ওপর কারো যাওয়া নিষেধ। আইন অবজ্ঞা করে কিছু মানুষ রেললাইনের ওপর পণ্য সাজিয়ে রীতিমতো ব্যবসা করছেন। তারা রেললাইনটিকে 'মৃত্যুফাঁদে' পরিণত করেছেন।

এমন দৃশ্য দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রকটভাবে দেখা যায়। সেসব এলাকার একটি দেশের বৃহত্তম রেল কারখানার শহর নীলফামারীর সৈয়দপুর।

গত বছর সৈয়দপুর শহরের ৩ কিলোমিটার রেললাইনের কয়েকটি অংশে ট্রেনে কাটা পড়ে অন্তত ১৬ জন মারা গেছেন।

দেশের বৃহত্তম রেল কারখানার শহর সৈয়দপুরে ট্রেনের কাটা পড়ে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। সৈয়দপুর রেলওয়ে থানা সূত্রে সম্প্রতি এমন উদ্বেগজনক তথ্য জানা গেছে।

নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহেও শহরের সেই ৩ কিলোমিটার রেললাইনের একটি অংশে ট্রেনে কাটা পড়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে।

ট্রেনের কাটা পড়ে মৃত্যু
সৈয়দপুর রেলস্টেশনের ২ নং গেটের কাছে মুন্সিপাড়ায় রেললাইনের ওপর ফলসহ অন্যান্য পণ্য নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

রেল পুলিশ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালালেও রেললাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ও হাঁটাচলাসহ অন্যান্য কাজ থেকে কাউকে যেন থামানোই যাচ্ছে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সৈয়দপুরের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল আনোয়ার শামীম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পশ্চিমাঞ্চল রেলের পার্বতীপুর-চিলাহাটি রেল সেকশনের মাত্র ৩ কিলোমিটার অংশ এক মৃত্যুফাঁদ। এই অংশে আছে সৈয়দপুর পৌরসভার দক্ষিণের বানিয়াপাড়া রেল সিগন্যাল থেকে উত্তরে ওয়াপদা মোড় রেলক্রসিং।'

'এটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ রেলরুট, যেখান দিয়ে আন্তঃদেশীয় ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেস বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলাচল করে। একাধিক আন্তঃনগর ট্রেন, দেশি-বিদেশি মালবাহী ওয়াগনও চলছে। অথচ এটাই এত অরক্ষিত,' যোগ করেন তিনি।

সম্প্রতি সরেজমিনে ঝুঁকিপূর্ণ সেই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শহরের মধ্যে ২ নং রেলগেটের ২ পাশে রেললাইনের ওপর বসেছে নানান সামগ্রীর অস্থায়ী দোকান।

এসব দোকানে হকাররা হাঁকডাক করে বিক্রি করছেন ফল, জুস, জুতা, লেপ-তোষক, মাছ-মাংস, স্টিলের ট্রাংক, বালতি ও ফার্নিচারসহ হরেক রকম পণ্য।

ট্রেনের কাটা পড়ে মৃত্যু
সৈয়দপুর রেলস্টেশনের ২ নং গেটের কাছে মুন্সিপাড়ায় রেললাইন ঢেকে গেছে বিক্রেতাদের পণ্যে। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

উল্লেখিত এই অংশে আরও আছে ৮ থেকে ১০টি কামারশালা। সেখানে কামাররা কাস্তে, কোদাল, কুড়াল, দা-বটি, কাটারিসহ অন্যান্য পণ্য তৈরি করছেন। হাতুড়ি পেটানোর শব্দ ও লোহা গলানোর আগুনে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এলাকাটি সরগরম থাকে।

এ এলাকার উত্তরে রেল স্টেশনের কাছে ১ নং রেলগেটের ২ পাশে, রেললাইনে ও লাইনের ২ পাশে আমদানিকৃত পুরাতন ও গরম কাপড়ের অনুমতিবিহীন অস্থায়ী বাজার বসে।

সেখানে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৩০০ দোকানে চলছে বেচাকেনা। নীলফামারীসহ রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় থেকে আসা ক্রেতাদের ভিড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে পা ফেলারও জায়গা থাকে না।

হঠাৎ ওই এলাকায় দেখা যায় হকার ও ক্রেতাদের ছোটাছুটি। ট্রেন এলে দোকানিরা মাথায়, কোলে যে যেভাবে পারেন মালপত্র গুছিয়ে লাইনের ২ পাশে সটকে পড়েন। সে সময় হুড়োহুড়ির কারণে আহত হন অনেকে।

২ পাশ কাঁপিয়ে ট্রেন চলে গেলে আবার দ্রুত হকার ও ক্রেতা-বিক্রেতারা পণ্য নিয়ে যার যার জায়গায় ফিরে আসেন। ক্রেতা আকর্ষণে শুরু হয় হাঁকডাক।

রেললাইন দিয়ে অনেককে খোশমেজাজে বেখেয়ালে হেঁটে যেতে দেখা যায়। যেকোনো মুহূর্তে ট্রেন আসতে পারে, এ কথা যেন তারা ভুলেই যান।

ট্রেনের কাটা পড়ে মৃত্যু
সৈয়দপুর রেলস্টেশনের ২ নং গেটের কাছে মুন্সিপাড়ায় রেললাইনের পাশে দোকান। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

কিশোর-যুবকদের মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে আনমনে রেললাইন দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়।

গত ৪ ডিসেম্বর ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায় কিশোর শান্ত রায় (১৪)। ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন পার হওয়ার সময় ওয়াপদা মোড় রেলক্রসিংয়ের কাছে বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে সে।

গত ২৭ নভেম্বর সৈয়দপুর শহরের বানিয়াপাড়া পয়েন্টে রাজশাহীগামী তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান কাশিরাম বেলপুকুর এলাকার মেহেদী হাসান (১৮)। তিনিও রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

গত ২০ অক্টোবর হোটেল শ্রমিক আকবর আলী রেললাইন ধরে বাড়ি ফেরার সময় খুলনাগামী রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়েন।

প্রতিটি মৃত্যুর পর রেল পুলিশ 'অপমৃত্যু' ধারায় মামলা করে দায়িত্ব শেষ করে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

সৈয়দপুরের স্টেশন মাস্টার ওবায়দুর রহমান রতন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই রেলপথে প্রতিদিন ১২ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এগুলোর মধ্যে ৫টি ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীগামী আন্তঃনগর ট্রেন।'

তিনি জানান, সৈয়দপুর রেল কারখানা এখানে হওয়ায় রেলের পশ্চিম জোনের অন্যান্য স্থান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেন এই পথ দিয়ে মেরামতের জন্য আনা হয় ও মেরামত শেষে ফিরে যায়। আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে ভারতীয় ট্রেন স্টেশনে আসে ঝুঁকির শঙ্কা নিয়ে।

সৈয়দপুর জেলা রেল পুলিশ সুপার (এসপি) সিদ্দিকী তানজিলুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা প্রায়ই রেললাইনের ২ পাশ থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদে অভিযান চালাই। অভিযানের কয়েকদিন পরই কোনো মহলের মদদে তারা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh trade deficit July-August FY25

Trade deficit narrows 2.6% in July-April

The country’s trade deficit narrowed by 2.60 percent in the first ten months of the current fiscal year compared to the same period a year ago, thanks to a rise in export earnings coupled with subdued imports..During the July-April period of fiscal year (FY) 2024-25, the trade gap was $18.

4h ago