বন কেটে ঘর-ঘের

বন কেটে ঘর
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার পশ্চিম মধুখালী গ্রামে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে ম্যানগ্রোভ (প্যারাবন) বনাঞ্চল ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছে। ছবি: সোহরাব হোসেন/ স্টার

পটুয়াখালী কলাপাড়ায় ছইলা, কেওড়া, বাইন, গোলগাছসহ নানান প্রজাতির গাছ কেটে ম্যানগ্রোভ (প্যারাবন) বনাঞ্চল ধ্বংসের অভিযোগ পাওয়া গেছে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে। বনাঞ্চলের ভেতর খালপাড় দখল তৈরি করা হচ্ছে ঘরবাড়ি ও মাছের ঘের।

অভিযোগ আছে, বনাঞ্চল ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে বন বিভাগের লোকজনেরই সহায়তায়।

স্থানীয় ও বনবিভাগ সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, লোনা পানি থেকে কৃষকের ফসল রক্ষায় ১৯৬০ এর দশকে কলাপাড়া উপজেলায় প্রায় ৩৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়।

বেড়িবাঁধ রক্ষায় এবং স্থানীয়দের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই ৩৩০ কিলোমিটারের পুরোটা জুড়েই ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ লাগায় বনবিভাগ। এসব গাছপালা বড় হয়ে গহীন বন সৃষ্টি করেছে। স্থানীয়দের জন্য পরিণত হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার 'সবুজ দেয়ালে'।

অবাধে গাছ কাটায় ক্রমে এই বনাঞ্চলে গাছ কমে যাচ্ছে। গাছ কেটে বনের ভেতর খালের তীরে ঘরবাড়ি তৈরি করছেন অনেকে। অনেকে খালে করছেন মাছের ঘের। এসব বন্ধে বন বিভাগের তৎপরতা চোখে পড়ছে না। বন বিভাগের লোকজনের যোগসাজশেই এ কাজগুলো চলছে বলে অভিযোগ আছে।

বন কেটে ঘর
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার পশ্চিম মধুখালী গ্রামে বনের ভেতর পাকা বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। ছবি: সোহরাব হোসেন/ স্টার

খাপড়াভাঙ্গা, বালিয়াতলী, নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ ও লতাচাপলী ইউনিয়নজুড়ে এই বনাঞ্চল। গত শনিবার কলাপাড়ার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের মধুখালী গ্রামের গিয়ে দেখা যায়, বনের ভেতর পূর্বধূখালী বাজারের দক্ষিণ পাশে সুতাখালী খালের তীরে মাটি কেটে তৈরি করা হচ্ছে মাছের ঘের। বেড়িবাঁধের বাইরে প্রায় দেড় একর জমিতে স্থানীয় আবুল কালাম খান এ ঘের তৈরি করছেন।

আবুল কালাম খানের দাবি, স্থানীয় ভূমিহীন মোসলেম সেখানে দেড় একর জমি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে ফকিরুল ও স্ত্রী ফরিদা বেগমের কাছ থেকে জমি কিনে তিনি মাছের ঘের তৈরি করছেন।

যদিও জমি বরাদ্দ বা কেনা সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র তিনি দেখাতে পারেননি।

কালামের মাছের ঘেরের দক্ষিণ পাশের বনে খালের তীর দখল করে স্থানীয় সাহিন হাওলাদার প্রায় এক একর জমিতে মাছের ঘের তৈরি করছেন। ঘেরের ভেতর থাকা বেশ কয়েকটি গাছ তিনি কেটে ফেলেছেন। তবে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।

বনাঞ্চলের ভেতর খালের পশ্চিম পাড়ের তীর দখল করে স্থানীয় ইউসুফ সিকদার পাকা বাড়ি তৈরি করছেন। প্রায় ৪০ শতাংশ জমি দখল করে নির্মাণাধীন এ বাড়ির বিষয়ে ইউসুফ সিকদার দাবি করেন, এটি তার নিজের জমি।

একই এলাকার ফেরদৌস গাজীও বনের খালের তীর দখল করে বাড়ি করেছেন। তার দাবি, তিনি পৈত্রিক জমিতে বাড়ি করেছেন। ওই এলাকায় তার মতো অনেকেই বাড়িঘর তৈরি করেছেন বলেও জানান তিনি।

বন কেটে ঘর
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার পূর্ব মধুখালী গ্রামে মাছের ঘের। ছবি: সোহরাব হোসেন/ স্টার

লতাচাপলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এক সময় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির ছইলা, কেওড়া, গোল, বাইন গাছে কলাপাড়া উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো পরিপূর্ণ ছিল। বাঁধের স্থায়িত্ব ও ঝড়-বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এ অঞ্চল রক্ষায় এসব বনাঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

তিনি বলেন, 'তবে এক শ্রেণির লোক রাতের আঁধারে বা সুবিধাজনক সময়ে বন থেকে গাছ কেটেই চলছেন। এসব গাছ তারা বিক্রিও করছেন। আবার কেউ কেউ বনভূমি বা খালগুলো দখল করে নিজেদের ঘরের পাশাপাশি মাছের ঘের তৈরি করছেন।'

আনছার উদ্দিন আরও বলেন, 'জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের বিকল্প নেই। গাছ কাটতে থাকায় বাঁধও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমার জানা মতে, ৩৩০ কিলোমিটারের বনাঞ্চল এখন কমে ২০০ কিলোমিটারের মতো হয়ে গেছে।'

বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও ধরেননি তিনি।

বন উজাড় ও বন বিভাগের যোগসাজশের অভিযোগের বিষয়ে পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। যারা এসব কাজে জড়িত তাদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।'

কত পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, 'তা সঠিকভাবে বলতে পারছি না। তবে আমরা নিয়মিত নতুন চারা রোপণ করি।'

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সভাপতি শংকর চন্দ্র বৈদ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ম্যানগ্রোভ প্রজাতি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংসের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English
National election

Political parties must support the election drive

The election in February 2026 is among the most important challenges that we are going to face.

6h ago