একুশের একাত্তর

ভাষা আন্দোলনে যশোর

যশোরে ভাষা আন্দোলন
যশোর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবি: সংগৃহীত

(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে ২১ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১টি জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আজকের পর্বে থাকছে রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)

ভাষা আন্দোলনের গণজোয়ার আছড়ে পড়েছিল যশোর জেলাতেও। এখানে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বেই, অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে যশোর রেখেছিল ভিন্ন ভূমিকা।

১৯৪৮ ও ১৯৫২—দুই পর্বের ভাষা আন্দোলনে মধ্যে প্রায় সব জেলাতেই যেখানে শেষপর্ব অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যশোরের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল একটু ভিন্ন। কারণ, যশোরে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম পর্বের ভাষা আন্দোলনই।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ব্যবহারের প্রস্তাব উত্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাববিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করেন। এর ঢেউ এসে পড়ে যশোরেও।

২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মতো যশোরে মাইকেল মধুসূদন কলেজের (এমএম কলেজের পুরাতন হোস্টেল) এলভি মিত্র হলে সভা করে ঢাকার 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'র মতো যশোরে সংগঠন গড়ে তোলা হয়। তখন যশোরের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ মার্চ এমএম কলেজের লেকচার হলে ছাত্রদের প্রতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠিত সেই সভাটি ছিল সর্বদলীয়। গুরুত্বপূর্ণ সেই সভায় বক্তব্য রাখেন ছাত্র ফেডারেশনের সুধীর রায়, হামিদা রহমান ও রণজিৎ মিত্র। ছাত্রলীগের পক্ষে আলমগীর সিদ্দিকী ও সৈয়দ আফজল হোসেন।

এরপর ঢাকার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ঢাকার মতো করে যশোরেও ১১ মার্চ ধর্মঘট ও মিছিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই ধর্মঘটকে সফল করতে ৭ মার্চ আবার সভা হয়। ৮ ও ৯ মার্চ মিছিল ও সভা হয়।

১০ মার্চ যশোরের জেলা প্রশাসক নোমানী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করলে ছাত্ররা জরুরি বৈঠক করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন।

১১ মার্চ যশোর শহরে মিছিল ও ধর্মঘট হয়। খণ্ড খণ্ড মিছিলে ছাত্র-জনতার স্লোগান ছিল 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'পুলিশি জুলুম চলবে না'। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যশোর হয়ে উঠে মিছিলের শহর। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন শহরবাসীও।

এর আগে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে আইনজীবী মশিউর রহমান ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে জোরালো মত দিলেও এবার তিনিই ১৪৪ ধারার ভাঙার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

সেদিন মিছিল থেকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৫০ নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।  এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন রাতে এমএম কলেজর পুরনো হোস্টেল ভবনের ছাদে ছাত্রনেতারা সংগ্রাম পরিষদের পরবর্তী করণীয় নিয়ে জরুরি সভা করেন।

পুলিশ সেই সভা সম্পর্কে জানতে পেরে কলেজ ভবন ঘেরাও করে। সেসময় কলেজের দারোয়ানের সাহায্যে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

১৯৪৮ সালের ১৩ মার্চ ছিল যশোরের ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বিক্ষোভময় দিন। সেদিন সকাল ৮টায় যশোর এমএম কলেজ থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলে অংশ নেন সরকারি কর্মচারীসহ প্রায় ৩ হাজার মানুষ।

১১ মার্চের গ্রেপ্তারকৃতদের যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন জনতার মিছিল চৌরাস্তা দিয়ে কালেক্টরেট ভবনের দিকে আসতে থাকে। দড়াটানার কাছে পুলিশ মিছিলে বাধা দিলে তাদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জের মুখে ছাত্র-জনতা ইট পাটকেল ছোড়ে। মুহূর্তেই এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

১৩ মার্চে জেলা প্রশাসক নোমানীর প্রশাসনিক উগ্রতা ও পুলিশ বাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি পূর্ব বঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে বিরোধী দলের সদস্যদের মাধ্যমে উত্থাপিত হলে মুখ্যমন্ত্রী তদন্তের আশ্বাস দেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথমভাগে যশোরের আন্দোলন চলেছে ১৮ মার্চের পরেও।

১৯৪৮ সালের তুলনায় অনেকখানি কম হলেও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও যশোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে যশোরের ছাত্র সমাজও। মধুসূদন কলেজ এবারো ছিল আন্দোলনের সূতিকাগার। সেদিন দীর্ঘ মিছিল শেষে টাউন হল প্রাঙ্গণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলা মুসলিম লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার জোর দাবি জানানো হয়।

২৫ ফেব্রুয়ারি মধুসূদন কলেজের শিক্ষক পরিষদের সভায় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কেন্দ্রের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন দেওয়া হয়।

২৮ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে পালিত হয় প্রতীকী শহীদ দিবস। সেদিন ছাত্র-জনতা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করেন। একই সঙ্গে টাউন হল ময়দানে আয়োজিত হয় বিশাল সমাবেশ।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যশোরে ধর্মঘট-হরতাল ও সভা-সমাবেশসহ বেশ কিছু কর্মসূচি পালিত হয়।

তথ্যসূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ আহমদ রফিক 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

'Why should an innocent person be punished?' says Jahangir on Hamid's arrival

The home adviser says Hamid will face legal consequences only if an investigation finds him guilty

4h ago