বাল্যবিয়েতে বাংলাদেশের আগে শুধু আফগানিস্তান!

গত ২০ ফেব্রুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার বাংলার একটি সংবাদ শিরোনাম 'বাল্যবিয়েতে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বাংলাদেশ'। খবরে বলা হয়, মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে একটি কর্মশালায় বক্তারা বলেছেন, বাল্যবিয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। বাংলাদেশের নিচে আছে একমাত্র আফগানিস্তান। শত চেষ্টা করেও বাল্যবিয়ে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঠেকানো যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশে এখনো ২৫ শতাংশ বাল্যবিয়ে হচ্ছে। সামাজিক সচেতনতা, নিরাপত্তার অভাব ও দারিদ্রই বাল্যবিয়ের মূল কারণ বলে তারা মনে করেন।

অনুষ্ঠানে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল লতিফ বলেছেন, 'বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে জনপ্রতিনিধি, কাজী, আইনজীবী, সাংবাদিকেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।'

এই কথাগুলো বেশ পুরোনো। কোনো একটি সমস্যা দীর্ঘদিনেও সমাধান করা না গেলে সরকার বা নীতিনির্ধারকদের তরফে বলা হয়, সরকারের একার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।

এটি বাস্তব সত্য। কোনো সামাজিক সমস্যাই সরকার একা সমাধান করতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার বা নীতিনির্ধারকরা কি সমস্যার মূল কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন এবং সেই সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছেন?

দেশে প্রকল্পের শেষ নেই। বস্তুত সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ একটি প্রকল্পশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে প্রকল্পের ছড়াছড়ি। কিন্তু বাল্যবিয়ের মতো একটা বিরাট সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে বড় কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে?

মুশকিল হলো, শিশুদের বিয়ে দেওয়া এক ধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়লেও বাংলাদেশের বিরাট জনগোষ্ঠী তা মনে করে না, বিশেষ করে অভিভাবকরা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে ধরনের ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল, সেটি কি চোখে পড়ে? শুধু বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করুন বললেই প্রতিহত হয় না। বরং কেন অভিভাবকরা তাদের কন্যাদের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিচ্ছেন বা দিতে চাইছেন, তাদের কাছে গিয়ে আন্তরিকভাবে, ভয়মুক্ত পরিবেশে সেই প্রশ্নটি কি রাষ্ট্র করেছে? শুধু ভয় দেখিয়ে কিংবা পুলিশিং করে কি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাবে?

বাল্যবিয়ে ও শাস্তি

বাংলাদেশে ১৯২৯ সাল থেকে বাল্য বিবাহ অবৈধ। ১৯৮০ সালে বিয়ের ন্যূনতম বয়স মেয়েদের ১৮ ও ছেলেদের ২১ নির্ধারণ করা হয়। তার মানে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকাল। তাই ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হলে তা শিশু বিবাহ বা বাল্য বিবাহ। অর্থাৎ, উভয়ের মধ্যে যেকোনো একজনের বয়স এর নিচে হলে তা আইনসম্মত হবে না। বাল্য বিবাহ শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, একজন ছেলেও যদি ১৮ বছরের আগে বিয়ে করে, তাহলে সেটিও বাল্য বিবাহ।

বাংলাদেশের আইনে বাল্যবিয়ের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। যেমন: ২১ বা তদুর্ধ্ব বয়সের অধিক বয়স্ক কোনো পুরুষ বা ১৮ বা তদুর্ধ্ব বয়সের অধিক বয়স্ক কোনো নারী কোনো অপরিণত বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি করলে তিনি ২ বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

কোনো ব্যক্তি বাল্যবিয়ে পরিচালনা করলে তার ২ বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন, যদি না তিনি প্রমাণ করতে পারেন যে, বিয়েটি বাল্যবিয়ে ছিল না বলে বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট যুক্তি ছিল।

বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িত পিতামাতা বা অভিভাবকরা যদি বিয়ের অনুমতি দেন অথবা বিয়ে বন্ধ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে ২ বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। তবে কোনো নারী দোষী সাব্যস্ত হলেও তাকে কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে না। অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে।

বাল্যবিয়ের কারণ

১. বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ হিসেবে দারিদ্রকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত ও ভারমুক্ত হতে চান। অর্থাৎ যেসব বাবা-মা মেয়েদের ঠিকমতো খাওয়াতে পারেন না, তাদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারেন না, তারা মেয়ের জন্য একটা বর খুঁজে নিতে চান, যাতে মেয়েটা অন্তত খেয়ে পরে বাঁচতে পারে।

২. সামাজিক নিরাপত্তার সংকটও বাল্যবিয়ের জন্য দায়ী। একটি মেয়ে শিশু যখন যৌবনপ্রাপ্ত হয়, তাদের পিতা-মাতা তখন তাদের সতীত্ব রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। মেয়ে শিশুর বয়ঃসন্ধির শুরুতে যৌন নির্যাতনের ভয়ে তারা ভীত হন। যে কারণে তাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত হতে চান।

৩. অবিবাহিত মেয়েদের যৌন হয়রানি এবং তা ঠেকাতে পুলিশের ব্যর্থতাও বাল্যবিয়েকে ত্বরান্বিত করে৷

৪. নিরক্ষরতাও বাল্যবিয়ের জন্য দায়ী করা হয়। যদিও উচ্চশিক্ষিত পরিবারেও বাল্যবিয়ের প্রবণতা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক অন্যান্য কারণ দায়ী। এসব কারণ নিয়ে আলোচনা কম হয়।

৫. যেসব মেয়ে স্কুল ছেড়ে যায়, বাবা-মা প্রায়ই তাদের বিয়ে দিয়ে দেন।

বাল্যবিয়ের পরিণাম

১. বাল্যবিয়ের মধ্য দিয়ে শিশু অধিকার লঙ্ঘন হয়।

২. পারিবারিক ও সামাজিক চাপে বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বেশির ভাগ কিশোরী গর্ভধারণ করে এবং সন্তান জন্ম দেয়—যা তাকে নানারকম শারীরিক ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়।

৩. কৈশোরকালীন গর্ভধারণের ফলে মেয়েরা অপুষ্টিতে ভোগে এবং গর্ভকালীন নানা জটিলতা তৈরি হয়।

৪. অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান প্রসবের কারণে মা ও শিশু উভয়রেই অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

৫. বাল্যবিয়ের কারণে স্বাস্থ্য পরিচর্যায় ব্যয় বেড়ে যায়, যা পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

৬. অনেক সময় স্বামী পরিত্যক্ত হওয়া এবং স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে পারিবারিক সহিংসতারও শিকার হয় বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা।

৭. অধিক সন্তান ধারণের ফলে নানা রকমের শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়।

৮. বাল্যবিয়ের ফলে মেয়েদের মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।

আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনা

দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, আমরা যখন নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, দুর্যোগ মোকাবিলাসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ায় শ্লাঘা বোধ করি এবং এসব ইস্যুতে শুধু এশিয়া নয়, বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকার কথা বলি; যখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট নাগরিক হওয়ার কথা বলি, তখন অন্তত দুটি বিষয়ে আমাদের তুলনা করতে হয় কট্টরপন্থি তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে। বিশেষ করে মুক্ত গণমাধ্যম সূচক এবং বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়েতে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের পরে শুধু আফগানিস্তান।

ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ২০২২ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আফগানিস্তানের চেয়েও পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। অবশ্য এসব সূচকের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বরাবরই সরকারের তরফে প্রশ্ন তোলা হয়। বাস্তবতা হলো, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ কোথায় অবস্থান করছে, সেটি বোঝার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠনের সূচক আমলে না নিলেও গণমাধ্যমকর্মীরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে।

যেহেতু এইসব সূচক তৈরি করা হয় বিভিন্ন মানদণ্ডে, ফলে কোনো কোনো বছর এদিক-ওদিক হতে পারে। কোনো একটি মানদণ্ডে বাংলাদেশ হয়তো এগিয়ে গেলেও অন্য কোনো মানদণ্ডে পিছিয়ে যায়। এগুলো গবেষণার বিষয়। কিন্তু সাদা চোখে মানুষ যা দেখে বা উপলব্ধি করে, সেটি অস্বীকারের সুযোগ নেই। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তানের পরেই বাংলাদেশে যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়, সেটি আশেপাশে তাকালেই স্পষ্ট হয়।

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারের নানা কর্মসূচি রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর। কোথাও বাল্যবিয়ের সংবাদ পেলেই প্রশাসনের সদস্যরা সেই বিয়ে প্রতিহত করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া বিয়ে পড়ানো এখন বলা চলে অসম্ভব। কিন্তু তারপরও নানা কৌশলে বিয়ে পড়ানো হয়। অনেক সময় গোপনে বিয়ে পড়িয়ে দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয় এবং মেয়ের বয়স ১৮ হওয়ার পরে সেটি সামাজিকভাবে জানানো হয়; নিজ এলাকায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের বিয়ে দেওয়া হলে সেটি জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকে দূরের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে পড়ান—এরকম ঘটনাও প্রায়শই ঘটে।

সুতরাং যেসব কারণে বাল্যবিয়ে হয় বা অভিভাবকরা ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতে বাধ্য হন, সেই বাস্তবতাগুলো বিবেচনায় না নিলে বাল্যবিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ দারিদ্র বিমোচন তথা মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো; 'কন্যাদায়গ্রস্ত' পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের মানবিক আচরণ এবং কন্যাশিশুর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে আফগানিস্তানের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে আমরা লজ্জিত হবো ঠিকই, আখেরে বাল্যবিয়ের মধ্য দিয়ে যে লাখো কন্যাশিশুর ভবিষ্যৎ ধ্বংস হচ্ছে, সেটি ঠেকানো যাবে না।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

12h ago