মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন

নির্মমতার নীরব সাক্ষী বিসিক শিল্প নগরীর টর্চার সেল

মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরেও পাবনার বিসিক শিল্প নগরীর টর্চার সেল এবং গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয়নি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

পাবনার বিসিক শিল্পনগরী এখন অনেক জমজমাট। জেলার সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে পাবনা বিসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই বিসিক শিল্পনগরীতেই লুকিয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের নির্মমতার ইতিহাস, পাবনার প্রথম গণহত্যার নির্মম স্মৃতি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৫২ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা বিসিক শিল্প নগরীর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

শুধু পাবনা বিসিক শিল্প নগরীই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা যেসব স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করেছে, নারীদের সম্ভ্রম হানি করেছে, সেসব টর্চার সেলগুলোতে এখনো নির্যাতিতদের আর্তনাদের নির্মম স্মৃতি ভেসে ওঠে।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ২৫ মার্চ রাতেই পাবনায় প্রবেশ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। হানাদার বাহিনী সেসময় ঘাঁটি গাড়ে পাবনা বিসিক শিল্প নগরী, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পাবনা পুরাতন টেলিফোন এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে।

পাকিস্তানি বাহিনী এসব স্থানে রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন শুরু করে। প্রথম দফায় যাদের ধরে আনা হয় তাদের বেশিরভাগই বন্দি ছিল পাবনা বিসিক শিল্প নগরীর টর্চার সেলে।

পাবনা বিসিক শিল্প নগরীর ডিজিএম মো. রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেই সময় পাকিস্তানি সেনাদের বড় অংশই পাবনা বিসিক শিল্পনগরী ও পাশ্ববর্তী পানি উন্নয়ন বোর্ডে আশ্রয় নেয়। বিসিক শিল্প নগরীর তৎকালীন ক্যান্টিন ভবনটি ব্যবহার করা হয় টর্চার সেল হিসেবে। অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা হয় বিসিকের ব্যংক ভবনটি।'

মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরেও পাবনার বিসিক শিল্প নগরীর টর্চার সেল এবং গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয়নি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

সরেজমিনে বিসিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিসিকের পুরনো অফিস ভবনটি এখনো বিসিকের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ক্যান্টিন ভবনের টর্চার সেলটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আগাছা জন্মে গেছে পুরো ভবনে। ব্যবহারের অনুপযোগী এ ভবনটি এখন পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়েছে। টর্চার সেলের পাশের যে স্থানে গণহত্যা সংগঠিত হয় সেটি এখন একটি কারখানার ভবন।

পাবনা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, পাবনায় প্রবেশের পরেই পাকিস্তানি সেনারা পাবনার বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের বিসিক শিল্প এলাকায় ধরে এনে টর্চার সেলে নির্মম নির্যাতন করে।

বিসিক শিল্প নগরীতে সেই সময়ের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন, সাইদ তালুকদার, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. অমনেন্দ্র দাক্ষি ও আব্দুল খালেককে ধরে আনা হয়। ২ দিন টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।

টর্চার সেলের পাশে বিসিকের সেই সময়ের নির্জন স্থানে গর্ত করে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে পাক সেনারা। গর্তের মধ্যেই লুটিয়ে পড়েন তারা। ৩ জন শহীদ হলেও গুলিবিদ্ধ আব্দুল খালেক বেঁচে যান। এটিই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর পাবনাতে প্রথম গণহত্যা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ধাপেই পাকিস্তানি বাহিনীর এমন নির্মমতায় বিক্ষুব্ধ লোকজন পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে সেনাদের ঘিরে দিনভর যুদ্ধ করে। অবশেষে জনতার প্রতিরধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা ২৯ মার্চ পাবনা থেকে পিছু হটে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিব জানান, এরপর মুক্তিকামী লোকজন ছুটে যায় বিসিক শিল্প নগরীতে সেখানেও পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেছে পরবর্তীতে গণকবর থেকে ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। আহত আব্দুল খালেকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

পাবনার বিসিক শিল্প নগরীতে নির্যাতন ও গণহত্যার নির্মম স্মৃতি মনে করে এখনো আঁতকে উঠেন প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযদ্ধারা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরেও পাবনার বিসিক শিল্প নগরীর টর্চার সেল এবং গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয়নি। যেখানে গণহত্যা করা হয় সেই স্থানটিতে এখন কারখানা গড়ে উঠেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ আর এখন এগুলো সম্পর্কে কিছুই চেনে না বললেই চলে।

পাবনা বিসিকের ডিজিএম মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, 'পাবনা বিসিক শিল্প নগরী এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন থাকলেও সংরক্ষণের অভাবে তা প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে নিজের ইচ্ছা মতো কোনো কাজ করা যায় না।'

ইতোপূর্বে বিসিক এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজ এগোয়নি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরেও পাবনার বিসিক শিল্প নগরীর টর্চার সেল এবং গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয়নি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

শুধু পাবনা বিসিক শিল্প এলাকাই নয় বরং পাবনার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন ও টর্চার সেলগুলো নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবি ইসলাম।  

তিনি বলেন, 'দ্বিতীয় দফায় পাকিস্তানি সেনারা ১১ এপ্রিল পাবনায় প্রবেশের পর পুরাতন পলিটেকনিক ভবন, নুরপুর ডাকবাংলো, নুরপুর বিদ্যুৎ অফিসে ঘাঁটি গাড়ে। এসব স্থানে গড়ে তোলা হয় টর্চার সেল। পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে নির্মমভাবে নির্যাতন করতো। তাদেরকে হত্যা করে মরদেহ অন্য স্থানে ফেলে আসত। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাবনায় পাকিস্তানি বাহিনী নির্মম নির্যাতন চালায়।'

নির্যাতনের এসব স্থানগুলো এখনই সংরক্ষণ করা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নির্মমতার ইতিহাস অজানা থেকে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Effective tariff for RMG exports to US climbs to 36.5%: BGMEA

The tariff will be a bit less if 20% of the cotton used in garment production is sourced from the USA

2h ago