সরকারি হাসপাতাল

অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের সিন্ডিকেটে ‘জিম্মি’ রোগীরা, দ্বিগুণ ভাড়া আদায়

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আসা যেসব রোগী অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নেন, সিন্ডিকেটের কারণে স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে তাদের দ্বিগুণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

চিকিৎসা নিতে এসে যারা ইতোমধ্যে বেশকিছু অর্থ ব্যয় করে ফেলেছেন বা করতে হবে, এটা তাদের ওপর বাড়তি চাপ।

২টি অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সদস্যরা প্রত্যেকটি সরকারি হাসপাতালেই সিন্ডিকেট গঠন করে রোগীদের 'জিম্মি' করে রেখেছে। ওই সিন্ডিকেট অন্য জেলার কোনো অ্যাম্বুলেন্সচালককে রোগী নিতে দেয় না। ফলে রোগীদের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে খালি ফিরতে হয়। সেজন্যই তারা প্রথম ট্রিপ ধরার সময়ে যাওয়া-আসার ভাড়া ধরে দ্বিগুণ অর্থ নেয়।

সংশ্লিষ্ট জেলার বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্স যদি রোগীকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে চায়, সেক্ষেত্রে সিন্ডিকেটকে ভাড়ার অর্ধেক অর্থ দিয়ে দিতে হয়।

অ্যাম্বুলেন্সমালিক, চালক ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানতে পেরেছে দ্য ডেইলি স্টার।

নোয়াখালীর বেলাল হোসেন (৪৫) গত ২০ ফেব্রুয়ারি তার ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করেন। নোয়াখালী থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আসতে তার খরচ হয়েছে ৫ হাজার টাকা। চিকিৎসা শেষে কয়েকদিন পর নোয়াখালীতে ফেরার জন্য ঢামেক হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গেলে সেখানকার সিন্ডিকেটের সদস্যরা ৬ হাজার টাকা চায়। বেলাল তখন নোয়াখালী থেকে আসা একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে চাইলে সিন্ডিকেট সদস্যরা তাকে বলেন, 'বাইরে থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্স' শুধু রোগীদের নামাতে পারে। তারা সেখান থেকে রোগী নিতে পারবে না।

ফোনে বেলাল তখন একজন অ্যাম্বুলেন্সচালকের সঙ্গে কথা বলেন, যিনি একজন রোগী নিয়ে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসেন। সেই চালক নোয়াখালী যেতে বেলালের কাছে ৩ হাজার টাকা চান, যা ঢামেক সিন্ডিকেটের চাওয়া ভাড়ার অর্ধেক। কিন্তু সেক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বেলালকে শর্ত দেয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে তাদেরকে ওই অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে হবে।

জানতে চাইলে ওই চালক বলেন, 'সিন্ডিকেটের সদস্যদের টাকা না দিলে আমাকে ঢামেক হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী নিতে দেওয়া হবে না।'

'হাসপাতালের এলাকা থেকে কোনো অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে চাইলে সিন্ডিকেট সদস্যদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তারা কমিশন হিসেবে ভাড়ার অর্ধেক টাকা রাখবে এবং সেই কারণেই আমাকে প্রকৃত ভাড়ার দ্বিগুণ নিতে হবে', ওই অ্যাম্বুলেন্সচালককে উদ্ধৃত করে বলে বেলাল।

'আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার করে ঢাকায় এসেছি। এই সিন্ডিকেট না থাকলে আমরা আরও অর্থ চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করতে পারতাম।'

সিন্ডিকেট

অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের ২টি সমিতি রয়েছে—বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি।

দুটির মধ্যে সদস্য সংখ্যার দিক থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি বড়। তাদের সদস্য সংখ্যা ২ হাজার ৭০০।

২টি সংগঠনই সারা দেশের সব অ্যাম্বুলেন্সকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং বিভিন্ন জেলায় তাদের সিন্ডিকেটও সেই জেলা ছাড়া অন্যান্য জেলার অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে রোগী নিয়ে যেতে দেয় না।

কে, কোন রোগী নিতে পারবে, সে বিষয়ে সিন্ডিকেটের একটি অলিখিত নিয়ম রয়েছে এবং সমিতির প্রতিটি হাসপাতালের ইউনিটের জন্য তা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।

যদি ঢাকা থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স একজন রোগীকে নিয়ে ঢামেক হাসপাতাল থেকে রাজশাহীতে যায়, সেই অ্যাম্বুলেন্সটিকে খালি ফিরতে হবে। আর যদি চালক সেখান থেকে কোনো রোগীকে ঢাকায় আনতে চায়, সেক্ষেত্রে সিন্ডিকেটকে কমিশন হিসেবে ভাড়ার অর্ধেক টাকা দিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাদল মাতবর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের সংগঠনের সদস্যদের মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা পার্কিং ফি এবং মাসে ২০০ টাকা মেম্বারশিপ ফি দিতে হয়। একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনতে ২০-২২ লাখ টাকা লাগে। ফলে রোগীরা যদি ঢামেক হাসপাতালের বাইরের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে, সেক্ষেত্রে মালিকদের লোকসান হবে।'

ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অ্যাম্বুলেন্সমালিকদের লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করতে এই সিন্ডিকেট করা হয়েছে।'

ঢামেক হাসপাতালের সিন্ডিকেট সদস্যরা জানান, তারা যদি বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্সকে রোগী নিতে দেয়, তাহলে ঢামেক হাসপাতালে থাকা অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা কমে আসবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুষ্টিয়ার এক অ্যাম্বুলেন্সমালিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীদের ঢামেক হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সিন্ডিকেট সদস্যরা আমাদের হাসপাতাল চত্বর থেকে তাড়িয়ে দেয়।'

রাজধানী ঢাকার আরও ২টি প্রধান সরকারি হাসপাতাল ঘুরে একই চিত্র দেখতে পান ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক। সেখানে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সচালক মিজান জানান, তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সদস্য ছাড়া কেউ এই হাসপাতাল থেকে রোগী নিতে পারবে না। অন্যরা সেখান থেকে রোগী নিয়ে যেতে চাইলে সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেস ইউনিটের সভাপতি আল আমিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাইরের অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে এখান থেকে রোগী নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। কারণ আমরাও অন্য কোনো জায়গা থেকে রোগী নিতে পারি না।'

ঢাকার ৩ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সিন্ডিকেটের আওতাধীন এসব অ্যাম্বুলেন্সের অবস্থা কোনোরকম। সেগুলোতে স্ট্রেচার ও অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া আর তেমন কোনো সরঞ্জাম নেই।

নেই কোনো নীতিমালা

ঢাকা মেট্রোপলিটন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অ্যাম্বুলেন্স কীভাবে চলবে, ভাড়া কত হবে, এ বিষয়ে সরকারি কোনো নীতিমালা করা হয়নি।'

অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট থাকার বিষয়টি স্বীকার করে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখনই আমি সিন্ডিকেট সদস্যদের চলে যেতে বলি, তারা চলে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আবার ফিরে আসে।'

তিনি জানান, রোগীরা যাতে সহজে অ্যাম্বুলেন্স পায়, সেজন্য ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি অ্যাপ চালু করেছে। কিন্তু সেবাগ্রহীতারা তাতে তেমন একটা আগ্রহী না।

অ্যাম্বুলেন্সের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়েছে সরকার। গতানুগতিক অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আমদানি শুল্ক ৩১ শতাংশ, আর মাইক্রোবাস কন্ডিশনে থাকা অ্যাম্বুলেন্সের আমদানি শুল্ক ৯০ শতাংশ।

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser yunus confirms election date

Election in February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night announced that the general election will be held before Ramadan in February 2026, kickstarting the process of handing over the power to an elected government.

5h ago