পর্যালোচনা

‘বাংলাদেশের কালচার’ ও প্রাসঙ্গিক বৈশাখ ভাবনা

আবুল মনসুর আহমদের 'বাংলাদেশের কালচার' বইয়ের রিভিউ প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম স্থান অর্জন করি। স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছি ৫ হাজার টাকার বই! সেইসব বই দেখতে দেখতে আমার আনন্দ-উত্তেজনা পৌঁছেছে ভিন্ন মাত্রায়। সেইসব অভিজ্ঞতায় 'বাংলাদেশের কালচার' পড়াকালীন চিন্তা ও চলমান সাংস্কৃতিক সংকট নিয়ে লেখাটি।

'বাংলাদেশের কালচার' হাইলাইটস করে পড়ার মত একটি বই। এর বিশেষত্ব এই যে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হলেও বর্তমানের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংকটে প্রাসঙ্গিক। এই মুহূর্তে দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা একটি বিষয়ের নিরিখে আলোচনা করলে হয়তো বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। 

আবুল মনসুর আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শন চর্চায় প্রবাদ পুরুষ। পূর্ববাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশ- ৩টি শাসনামলেরই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ২১ দফার রচয়িতা। এছাড়া ১৯৬৬ সালের ৬দফার যে ব্যাখ্যা প্রচার করা হয়েছিল তারও রচয়িতা আবুল মনসুর আহমদ। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় বই 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর'। বাংলাদেশে যারাই আবুল মনসুর আহমদকে চেনেন তাদের বেশিরভাগেরই লেখকের সাথে পরিচয় হয় বইটির মাধ্যমে। তবে রিভিউ প্রতিযোগিতার জন্য পড়তে হলো সে বইটির খোঁজ প্রতিযোগিতা না হলে আমি জানতামই না। আর আমার জন্য আবুল মনসুর আহমদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি দৃষ্টির অগোচরে রয়ে যেত। শুধু এতটুকুর জন্যেই আয়োজকদের কাছে কৃতজ্ঞ। 

'বাংলাদেশের কালচার' নাম প্রবন্ধটি জুড়েই তিনি বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখিয়েছেন ঐতিহাসিক ভাবেই এই অঞ্চলের মুসলমানরদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। তিনি দেখিয়েছেন সংস্কৃতির বাহ্যিক প্রকাশ বলতে আমরা যে ক্ষেত্রগুলোকে বুঝিঃ সংগীত, নৃত্য কিংবা চিত্রশিল্পে এই অঞ্চলের মুসলমানদের উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। আব্বাসুদ্দিনের মিঠা-দরায গলায়, বুলবুল চৌধুরীর নিক্বণে, জয়নুল আবেদিন তুলিতে তিনি বাঙালি মুসলিমের সাংস্কৃতিক প্রতিভাকে প্রমাণস্বরূপ হাজির করেছেন। আর সংস্কৃতির এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা দেখাতে বাদ রাখেননি আমির খসরু থেকে ইমাম আল-গাযযালী পর্যন্ত। সাংস্কৃতিক ভাবে সমৃদ্ধ এই ইসলাম এই বাঙালি মুসমানের জীবনে কী করে নিরানন্দের ধর্ম হয়ে আসলো সেই ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। দোষ দিয়েছেন ওয়াহাবি বিশুদ্ধচারী ও ইংরেজ শাসকদের।'

তিনি বলেছেন এই বিশুদ্ধচারীরা ঈদুল ফিতর কিংবা মহররমের মত আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলোকেও নিরান্দন্দ করেছেন। আর এই নিরানন্দের পরিণতি হিসাবে বাঙালি মুসলমানেরা আনন্দের পাওনা মিটিয়ে নিয়েছে 'সিনেমা দেখিয়া, কুস্থানে গিয়া এবং ক্লাবে 'ঈদবল' নাচিয়া।' ভাগ্য ভালো যে আবুল মনসুর আহমদ এখন বেঁচে নেই, থাকলে বাঙালি মুসলমান এখন ঈদ, বিশেষত চাঁদরাত আরও কত 'কুকর্ম' করে উদযাপন করে তা দেখে নিশ্চয়ই ব্যথিত হতেন। 

ধর্মীয় বিশুদ্ধতাবাদীরা ইতিমধ্যে শবে বরাত কে বিদায় জানিয়েছে, মহররমকেও বিদায় জানিয়েছে। এই মুহূর্তে তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে পহেলা বৈশাখ। যে পহেলা বৈশাখ গ্রামের লোকজ সংস্কৃতির অংশ ছিল কিংবা ব্যবসায়ীর হালখাতা খোলার দিন ছিলো তা হঠাৎই কী করে ধর্মের বিপরীতে এসে দাঁড়ালো তা ই এখন বড় প্রশ্ন। প্রশ্ন আছে আরও অনেক, যদি দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে পহেলা বৈশাখ তাঁদের সংস্কৃতি না, তারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সে সমর্থন দিতে পারবেননা, তাদের কী আদৌও ঢাকার মধ্যবিত্তদের এই উৎসবে জোর করে 'এটা তোমার সংস্কৃতি' বলে যুক্ত করা যায়?

তাছাড়া ঢাকার এই পহেলা বৈশাখের নয়া রূপ যা গ্রামীণ পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গগুলো বাদ দিয়ে তৈরি তা কতটা সার্বজনীন। এই সংস্কৃতি ঢাকার একটা নির্দিষ্ট ভাব-ধারার মানুষের বাইরে কতজন মানুষ এই আয়োজনগুলোকে আপন করে নিতে পারে? অর্থাৎ ঢাকার মধ্যবিত্তদের এই পহেলা বৈশাখ সত্যিকার অর্থে সর্বজনগামী না হয়ে থাকে তবে দায় এখনে ঢাকার মধ্যবিত্তদের ও নিতে হয়। দেখলাম অনেকে বলছেন, ধর্ম আর সংস্কৃতি আলাদা জিনিস। এক্ষেত্রে এবার পহেলা বৈশাখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম অনেকে কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষ্যে বলছেন, "অশিক্ষিত লোকের সংস্কৃতি হল তাঁর ধর্ম, আর শিক্ষিত লোকের ধর্ম হল তাঁর সংস্কৃতি।" এই আলোচনায় একটা বিভ্রাট ছিল। মূল উক্তিটি হলো, "ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম।" মূল উক্তিটি আসলে পাওয়া যায় মোতাহার হোসেন চৌধুরীর 'সংস্কৃতি কথা' প্রবন্ধে। দুটি উক্তির শব্দবিন্যাস ভিন্ন হলেও মূল সুর এক- তা হলো ধর্ম আর সংস্কৃতির বৈপরীত্য বা সংস্কৃতিকে ধর্মপালনকারীদের কিছুটা নাগালের বাইরে রাখার চেষ্টা।

এই আলোচনায় আবুল মনসুর আহমদ খুবই পরিষ্কার ছিলেন। তিনি বলছেন, "ধর্মের সবটুকুই কালচার, কিন্তু কালচারের সবটুকুই ধর্ম নয়।" বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক দুর্খেইমও ধর্ম আর সংস্কৃতিকে একইভাবে আলাদা করেননি। দুর্খেইমের মতে, ধর্মকে বাদ দিয়ে কোনো সমাজ-জীবনের ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ধর্ম সমাজ-জীবনের বাস্তব ভিত্তি। বিখ্যাত জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাকস বেবরের মতে, মানুষ ইতিহাস গড়তে চায় তার আপন মূল-চেতনার উপর ভিত্তি করে। আর মূল-চেতনার উৎস হিসেবে ইতিহাসে ধর্ম পালন করে প্রধান ভূমিকা। 

পহেলা বৈশাখকে যেভাবে ধর্মের বিপরীতে দাড় করানো হয়েছে তা সত্যিই দুঃখজনক। অথচ, এই পহেলা বৈশাখের শক্তি আছে এই ভূমির 'বাঙালি আর মুসলিমদের' এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার। একটি উৎসবে 'হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানের উর্ধ্বে গিয়ে সকলকে মানুষ-সত্যে পরিপূর্ণ করার। বিশ্বায়নের চকচকে মুদ্রাটির অপর পার্শ্বে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল বা 'পেরিফেরির' সংস্কৃতিকে হাওয়ায় মিলিয়ে ফেলার যেই বৈশ্বিক চর্চা তার বিরুদ্ধেও পহেলা বৈশাখ আমাদের এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার ঢাল হতে পারে, রুখতে পারে রক্ষণশীল ধর্মীয় বিশুদ্ধতাবাদ। 

মানুষকে কী আদৌ নিরানন্দ করে রাখা সম্ভব? চাপ প্রয়োগ করে তাকে উৎসবে প্রাণ মেলানো রুখে দিলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই কী বেশি নয়? পহেলা বৈশাখ আমাদের এই অঞ্চলে সংস্কৃতির যতটুকু বেঁচে আছে তার নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা শেষ নির্যাসের মত। আবুল মনসুর আহমদকে নিয়ে সেদিনের অনুষ্ঠানে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, "সংস্কৃতি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা জানি। সভ্যতার চাইতেও সংস্কৃতি বড় এ কথাটি আমরা জানি। কিন্তু সংস্কৃতির চর্চা বাংলাদেশে এখন অত্যন্ত নিম্ন জায়গায় পৌঁছে গেছে। যেমনভাবে আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, তেমনভাবে আমাদের সংস্কৃতির চর্চাও শুকিয়ে যাচ্ছে।" 

সত্যিই তাই, প্রতিদিন চারপাশে সংস্কৃতির যত উপাদান দেখি তার কোনোটাতেই আমাদের নিজস্বতা কিংবা স্বকীয়তা নেই। এই পরাবলম্বন কিংবা বিভিন্ন সংস্কৃতি ধার করে পালন করা জাতি আদৌ কী বেশিদূর যেতে পারবে? নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা বাঙালি সংস্কৃতির বছরে নিজেদের সংস্কৃতির প্রচার কিংবা চর্চা করার একমাত্র দিনটিকে যারা ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করায় তাদের রাজনীতি বোঝা প্রয়োজন। 
পহেলা বৈশাখ বাঙালির সকল শ্রেণী, বর্ণ, ধর্মের মানুষের সার্বজনীন একটি উৎসব। যারা বৈশাখের আয়োজন-উদযাপন ঢাকা কেন্দ্রিক নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীর উৎসবে পরিণত করে দেশের সিংহভাগকে তাদের নিজেদের উৎসবের বিপরীতে দাঁড় করালো তাদের রাজনীতিও বোঝা প্রয়োজন। তাই এর উদযাপন এমনই হওয়া প্রয়োজন যাতে সকলেই এখানে দ্বিধাহীনভাবে অংশ নিতে পারে। আর যে কারো সংস্কৃতিতে স্বকীয়তা না থাকলে দিশাহীন পথ থেকে ফিরে আসার উপায় খুঁজে পাবে না প্রজন্ম।  

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

3h ago