‘লবণ বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হলো আমার স্বামীকে’

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন লবণ চাষি রিদোয়ান। ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার দিন বিকেলে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের বগাচতর ঘোনা এলাকায় মাঠের লবণ রক্ষা করতে গিয়ে ঝড়-বৃষ্টিতে অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি।
দুই সন্তানের সঙ্গে রাবেয়া। ছবি: স্টার

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন লবণ চাষি রিদোয়ান। ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার দিন বিকেলে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের বগাচতর ঘোনা এলাকায় মাঠের লবণ রক্ষা করতে গিয়ে ঝড়-বৃষ্টিতে অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পুরো পরিবার এখন দিশাহারা।

৩৫ বছর বয়সী রিদোয়ানের বাড়ি মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজি গ্রামে। দুই সন্তানের বাবা রিদোয়ান ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। জমি বর্গা নিয়ে বছরে ৬ মাস লবণ চাষ করতেন তিনি। বাকি সময়টা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।

মঙ্গলবার বিকেলে রিদোয়ানের মাটির ঘরের সামনের দরজায় বসে দুই সন্তানকে নিয়ে পথের দিকে চেয়ে ছিলেন রাবেয়া। স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করার পর ডুকরে কেঁদে ওঠেন ২৫ বছরের এই নারী।

'ঘটনার দিন রাত ৩টায় ঘুম থেকে উঠে স্বামীর ভাত-তরকারি রান্না করি। এরপর টিফিন ক্যারিয়ারে করে ভাত দিয়ে ভোর ৫টার দিকে উনাকে বিদায় দিয়েছিলাম। আধঘণ্টা পর ঘরে ফিরে তিনি টিফিন রেখে বলেন, দুপুরের মধ্যে ফিরে আসব, তাই ভাত নিব না। এরপর ছোট ছেলেকে আদর করে তিনি লবণের মাঠে রওনা দেন, সঙ্গে দুজন শ্রমিক নিয়ে যান,' বলেন রাবেয়া।

একই গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল হক থেকে বর্গা নিয়ে ২৪০ শতক জমিতে লবণ চাষ করতেন রিদোয়ান। খরচ বাদে লাভের অর্ধেক টাকা দিতে হতো জমির মালিককে। ঘূর্ণিঝড় মোখা যেদিন আঘাত করে সেদিন জমিতে তার আড়াই শ মণ লবণ পড়েছিল। এই লবণের বাজার মূল্য প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

রাবেয়া বেগম বলেন, লবণের মাঠ থেকে ফিরে না আসায় বিকেল ৩টার দিকে স্বামীর খোঁজ নিতে লবণ মাঠের আরেক শ্রমিক লোকমানের বাসায় যাই। গিয়ে দেখি লোকমান ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার মা তার শরীরে সেঁক দিচ্ছে।

'লোকমানকে জিজ্ঞেস করলে জানান, আমার স্বামী মাঠে কাজ করছেন। দুশ্চিন্তা হওয়ায় ঘরে না ঢুকে রাস্তার পায়চারি করছিলাম আমি। ঘণ্টাখানেক পর একটা ছোট ছেলে এসে জানায়, আমার স্বামী লবণ মাঠের ড্রেনে পড়ে যান। অন্য লবণ চাষিরা তাকে কাঁধে করে বাজারের ফার্মেসিতে ও পরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। পরে খবর পাই তিনি মারা গেছেন,' বলেন রাবেয়া।

যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন রাবেয়ার চোখ পানিতে ছলছল করছিল। বার বার বলছিলেন, 'এতিম দুইয়ো পোয়া লইয়েরে আই এহন হার হাছে যাইয়িম।'

স্বামীর এমন নির্মম পরিণতির কথা দূর কল্পনাতেও ছিল না রাবেয়ার। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও তাদের সংসার ছিল গুছানো। স্বামীকে হারিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনি।

রাবেয়া বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগের দিনও মাঠে কাজ সেরে দুপুরের মধ্যে ঘরে ফিরেছিলেন রিদোয়ান। সেদিনও উনার আসার পথ চেয়ে ছিলাম। লবণ বাঁচাতে গিয়ে জীবন হারাতে হলো আমার স্বামীকে।

সোমবার সকাল ১০টায় স্থানীয় ঈদগাহে জানাযা শেষে রিদোয়ানের দাফন হয়। স্থানীয় এমপি, ইউনিয়ন পরিষদের দুজন চেয়ারম্যান ও লবণ ব্যবসায়ী সমিতি রিদোয়ানের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। তবে সরকারি কোনো সহায়তা পায়নি তার পরিবার।

রিদোয়ানের লবণ মাঠের মালিক আজিজুল হক বলেন, আমি শুনেছি তার দুইটি সন্তান আর স্ত্রী আছে ঘরে। তাদেরকে আর্থিকভাবে সহায়তা করব।

ঘূর্ণিঝড় মোখা উপকূলে আঘাত করার দিন রিদোয়ানসহ আরও ৩ জন লবণচাষি মারা গেছেন মহেশখালীতে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং বাতাসের মধ্যে কাজ করার কারণে তারা মারা গেছেন।

হোয়ানক ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান মীর কাসেম চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান, মাঠে পড়ে থাকা লবণ রক্ষা করতে প্রায় ১০০ জন লবণ চাষি রোববার কাজে গিয়েছিলেন। বৃষ্টি থেকে লবণ রক্ষা করতে মাটিতে গর্ত করে প্লাস্টিকের শিটে মুড়িয়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। ঝড়-বৃষ্টিতে কাজ করার সময় ঠান্ডায় ৬-৭ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে ৩ জন মারা গেছেন।

মহেশখালীর ইউএনও মো. ইয়াছিন বলেন, ওই লবণ চাষি মাঠে কাজ করার সময় মারা গেছেন। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মারা যাননি। তবুও আমরা তাদের তালিকা জেলা প্রশাসনে পাঠিয়ে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য। বরাদ্দ পেলে পরিবারগুলোকে আমরা সহায়তা দেব।

Comments