ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাংবাদিককে ‘পলাতক দেখিয়ে’ চার্জশিট

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তার 'সম্মান ক্ষুণ্ন ও হাজারো নেতাকর্মীকে মর্মাহত' করার দায়ে এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে করা  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ।

২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক ফারুক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় বাঁশখালী থানা পুলিশ। তবে মামলার বিষয়ে ২০২৩ সালের মে মাসে থানায় খোঁজ খবর নিতে গেলে ফারুক জানতে পারেন, তাকে পলাতক দেখিয়ে চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইবুনালে চার্জশিট দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, বাঁশখালী থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক প্রদীপ চক্রবর্তী।

তবে পুলিশ বলছে, যা করা হয়েছে, আইনগতভাবেই করা হয়েছে।

ফারুক জানান, ২০২০ সালের ২৬ জুলাই বাঁশখালীতে মৌলভি সৈয়দের বড় ভাই ও মুক্তিযাদ্ধা ডা. আলী আশরাফের মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অব অনার না দেওয়া নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

২০২০ সালের ১ আগস্ট সাংবাদিক ফারুকের বিরুদ্ধে ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর ভাবমূর্তি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্মান ক্ষুণ্ন করাসহ কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করার অপরাধে আওয়ামী লীগ কর্মী মোরশেদুর রহমান বাদী হয়ে মামলা করেন বাঁশখালী থানায়।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ফারুক তার ফেসবুক থেকে পোস্ট করে বলেন 'এমপি ও কতিপয় চেয়ারম্যানের কললিস্ট চেক করলে বেরিয়ে আসবে বড় আব্বুকে "গার্ড অব অনার" না দেওয়ার নেপথ্যের কাহিনি। আওয়ামী লীগ নামধারী রাজাকারদের মুখোশ উন্মোচন করা হোক' এবং একই আইডি থেকে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই দুপুর ২টা ৩৬ মিনিটে পোস্ট করা হয় যে, '১০ মিনিট পর পর এমপি কাদেরকে ফোন করে "গার্ড অব অনার" না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, জাতি তা জানতে চায়'।

এরপর এমপির মৌখিক নির্দেশে মোরশেদ আইনানুগ ব্যবস্থার আশ্রয় নিয়েছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করেন। মামলার সঙ্গে ফারুকের সেই পোস্টের স্ক্রিনশটের কপিও সংযুক্ত করা হয়।

মামলা দায়েরের পর তা নিয়ে চট্টগ্রামে প্রতিবাদ করেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। তখন মামলাটির বিষয়ে 'দেখবেন' বলে মৌখিক আশ্বাস দেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কয়েকজন এবং তারা আন্দোলন না করতে অনুরোধ জানান।

মামলা দায়েরের পর বাঁশখালী থানার এসআই নাজমুল হক এর দায়িত্ব পান। এরপর তদন্তভার নেন তৎকালীন এসআই প্রদীপ। আদালতে দেওয়া চার্জশিটে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'আসামি আবদুল্লাহ আল ফারুক এমপিকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে মনগড়া, ভিত্তিহীন, কুরুচিপূর্ণ লেখা ফেসবুকের আইডিতে পোস্ট করে তার ভাবমূর্তি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তার সম্মান ক্ষুণ্ন করেছেন এবং এতে হাজারো নেতারকর্মী হতবাক ও মর্মাহত হয়েছে, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৫ (১), ২৯ (১) ও ৩১ (১) ধারায় অপরাধের সত্যতা প্রমাণিত হয়।'

এ ছাড়া তিনি উল্লেখ করেন, সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ফরেনসিক পরীক্ষায় এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তিনি ফারুককে পলাতক দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করতে আদালতে প্রার্থনা জানান।

ফারুক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মামলা ও চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। পুলিশ আমাকে পলাতক দেখিয়ে গোপনে চার্জশিট দিয়েছে। অথচ আমি চট্টগ্রাম শহর ও বাঁশখালীতেই ছিলাম। মামলাটি বর্তমানে সাইবার ট্রাইব্যুনালে নথিভুক্ত রয়েছে। আমি আইনিভাবে এর জন্য লড়ছি।'

তবে গোপনে চার্জশিট দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন মামলা হয়ে, তখন আমি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ছিলাম। চার্জশিট দেওয়ার সময় আমি ছিলাম না। আর এখানে আইনের বাইরে কিছুই করা হয়নি। যা হয়েছে আইনগতভাবেই হয়েছে।'

মামলার বাদী মোরশেদুর রহমান গতকাল বিকেলে টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।'

বিস্তারিত জানার জন্য তিনি আদালতে যোগাযোগ করতে বলেন।

চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি তপন চক্রবর্তী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নানান বিতর্কিত ধারা বাতিলের জন্য আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। এভাবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হলে এই আইন আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং সমালোচনাও প্রবল হবে।'

এ বিষয়ে জানতে সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুকে ফোন করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর ফোন কেটে দেন। এরপর আবারও ফোন দিলে তিনি ধরেননি।

তার ব্যক্তিগত সহকারী একেএম মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মামলার জন্য এমপি কোনো ধরনের মৌখিক নির্দেশ দেননি। বাদী নিজেই সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছেন। তবে ওই সাংবাদিক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এমপির সম্মান ক্ষুণ্ন করেছেন।'

উল্লেখ্য, বিএনপির এক নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে গত মে'তে বাঁশখালীতে আয়োজিত সমাবেশ ও মিছিলে সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান তার লাইসেন্স করা অস্ত্র প্রকাশ্যে প্রদর্শন করেন, যা নিয়ে পরবর্তীতে সমালোচনা শুরু হয়। এরপর জেলা প্রসাশক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান এ বিষয়ে তার মৌখিক ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আরও সাবধানতা অবলম্বনের অনুরোধ জানান।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। ২০১৮ সালেও পুনরায় নির্বাচিত হন তিনি।

এর আগে ২০১৬ সালের ১ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে চড়-থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি মেরে আলোচনায় আসেন মোস্তাফিজুর রহমান। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পছন্দমতো ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ায় তাকে মারধর করা হয়েছিল। এই ঘটনায় জাহিদুল ইসলাম বাঁশখালী থানায় একটি মামলা করেছিলেন। জাহিদুল এখন শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার কর্মকর্তা।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের কটূক্তি করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় আবার আলোচনায় আসেন তিনি। ২০২০ সালের আগস্টে বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি বলে মন্তব্য করেও বিতর্কের সৃষ্টি করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh Police: Designed to inflict high casualties

A closer look at police’s arms procurement records reveals the brutal truth behind the July killings; the force bought 7 times more lethal weapons than non-lethal ones in 2021-23

8h ago