নির্বাচনের মাঠে আবারও বিতর্কিত ‘পর্যবেক্ষক’ সংস্থা

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আলোচিত হয় ২টি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা 'সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন' এবং 'ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম'। কেননা, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী অন্যান্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কেউই এই ২ সংস্থা সম্পর্কে কিছুই জানতো না।

নামে 'সার্ক' শব্দটি থাকলেও 'সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন'র সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের কোনো সম্পর্কই নেই। এমনকি নিজের লেখা বইয়ে সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনকে 'একটি ভুয়া সংগঠন' বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ৩১ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সংস্থা ২টি বলে, 'একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতীতের চেয়ে অনেকাংশে ভালো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।'

সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের একজন নির্বাচন পর্যবেক্ষক কানাডিয়ান নাগরিক তানিয়া ডন ফস্টার তখন বলেছিলেন, নির্বাচন 'অত্যন্ত সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক' হয়েছে। আরও বলেছিলেন, কানাডায়ও একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয় বলে তিনি মনে করেন।

যদিও, তানিয়া ফস্টারের বরাত দিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে 'এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে জড়িত থাকায় তিনি অনুতপ্ত'।

সেই আলোচিত ২ পর্যবেক্ষক সংস্থার একটি 'ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম' দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ঢাকায় এনে ৪ জন বিদেশি নাগরিককে 'নির্বাচন পর্যবেক্ষক' হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে এই 'নির্বাচন পর্যবেক্ষক'দের পরিচয় এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণে তাদের আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি না, তা নিয়ে।

'সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন' এবং 'ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম'—২টি সংস্থার সঙ্গেই জড়িত আছেন মোহাম্মদ আবেদ আলী। তিনি যথাক্রমে একটির মহাসচিব এবং অন্যটির চেয়ারম্যান।

এবারের বিদেশি 'নির্বাচন পর্যবেক্ষক'দের সম্পর্কে জানতে চাইলে আজ মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে ঢাকা সফর করেছেন টেরি ইসলে, নিক পল, এন্ডি লিন ও ইউসুকি সুগু। তারা যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড, চীন ও জাপানের নাগরিক। তাদের মধ্যে ২ জন সাংবাদিক এবং ২ জন সমাজকর্মী।

তিনি বলেন, 'বিদেশি অতিথিরা গত ২৮ জুলাই এসেছিলেন, আজ সকালে চলে গেছেন।'

এই 'নির্বাচন পর্যবেক্ষক'রা নিজ নিজ দেশের স্বনামধন্য কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থার সদস্য কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে খোদ নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের।

৪ বিদেশি নাগরিকের মধ্যে নিক পল 'ইইউ রিপোর্টার' নামের একটি অনলাইনভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমের 'পলিটিক্যাল এডিটর' (রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদক) বলে জানা গেছে। টেরি ইসলে যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টিভির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। টেরিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুক্তরাষ্ট্রের টেনেট ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনালের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করা হলেও যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। টেরি মূলত একজন নিবন্ধিত বিনিয়োগ ব্যাংকার।

এ ছাড়া, এন্ডি লিন ও ইউসুকি সুগুকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হলেও তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় আবেদ আলীর কাছেই। তিনি বলেন, 'তাদের মধ্যে ২ জন সিনিয়র সাংবাদিক, পাশাপাশি তাদের ব্যবসা আছে। আমারও সামাজিকভাবে অন্য ব্যবসা আছে। এটা তো কোনো দোষ হতে পারে না। যুক্তরাজ্যে টেরির ব্যবসা আছে। টেরি আগামী মাসে কংগ্রেসের ৫ জনের টিম নিয়ে বাংলাদেশে আসবেন। তখন আপনারা বুঝবেন তিনি পরিচিত, না কি অপরিচিত।'

তিনি বলেন, 'সরকার বা দূতাবাস বা অন্য কোনো সংগঠনের হয়ে কেউ আসলে তাদের পক্ষপাতী হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু সিভিল সোসাইটির কেউ আসলে আস্থার জায়গাটা আরও বৃদ্ধি পায়। কারণ, সিভিল সোসাইটি এখানে কারো দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করেন।'

আবেদ আলী আরও বলেন, 'তারা (বিদেশি অতিথিরা) নিজেরাই বলেছেন, "আমরা যুক্তরাষ্ট্র বা সরকারের কোনো প্রতিনিধি নই। আমরা ইন্ডিপেন্ডেট। আমরা চেষ্টা করছি বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরতে।"'

গত ৩০ জুলাই এই ৪ বিদেশি 'নির্বাচন পর্যবেক্ষক'কে নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন টেরি। সাংবাদিকরা তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না করলেও তিনি নিজ থেকেই বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অসাংবিধানিক ও বেআইনি এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে।

সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ডাকে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আসা তানিয়া ফস্টার এ দেশে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে রয়টার্সকে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই বিষয়টি উঠে এসেছে প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের লেখা 'নির্বাচননামা: নির্বাচন কমিশনে আমার দিনগুলো' বইয়ে।

তিনি লিখেছেন, 'ভোটে একজন বিদেশি পর্যবেক্ষককে নিয়ে যা ঘটেছে, তাকে পর্যবেক্ষণ কেলেঙ্কারি আখ্যা দেওয়া যায়।'

তিনি আরও লিখেছেন, 'সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন নামে একটি ভুঁইফোড় সংগঠন, যার সঙ্গে সার্কের কোনো সম্পর্কই নেই; কানাডা, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে কয়েকজন পর্যবেক্ষককে নিয়ে আসে। ওই দলে ছিলেন তানিয়া ফস্টার। কানাডার একটি প্রদেশের প্রাদেশিক সরকারের নীতি বিশ্লেষক ফস্টার বলেন, তিনি কানাডায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের কাছে জানতে পারেন, সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক খুঁজছে। "আমি যোগ্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলাম, কারণ আমার মনে হলো, এই অভিজ্ঞতাটা চমকপ্রদই হবে। আমি সার্কে ও নির্বাচন কমিশনে আবেদন করলাম।" তিনি জানান, তাঁর মেয়ে ক্লোত্র ফস্টারও পর্যবেক্ষক প্যানেলে যোগ দেন। এর আগে কোনো জাতীয় নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না।'

বইয়ে মাহবুব তালুকদার উল্লেখ করেছেন, 'তানিয়া ফস্টার বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে সার্কের হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের যোগসূত্র রয়েছে বা সংগঠনটি যে সার্কের কেউ না, তা তিনি জানতেন না।'

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসা ৪ বিদেশির বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই ৪ জনের কাউকেই তিনি চেনেন না।

তিনি আরও বলেন, 'এই ৪ বিদেশি নাগরিকের কথা শুনে এবং তাদের সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে তাতে মনে হচ্ছে, কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করতেই তাদের নিয়ে আসা হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English
Polytechnic students protest Bangladesh 2025

Polytechnic students issue 48-hr ultimatum over six-point demand

Threaten a long march to Dhaka if govt doesn't respond to demands

3h ago