বিচার বিভাগের ওপর আস্থার কমতি শুধু বিচারকদের জন্য নয়: প্রধান বিচারপতি
আস্থার ঘাটতি সর্বত্রই আছে মন্তব্য করে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, বিচার বিভাগের ওপরে আস্থার ঘাটতি নেই এ কথা আমি বলবো না।
তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগের ওপর আস্থার কমতি যেটা হয়েছে, এটা শুধু বিচারকদের জন্য—তা নয়।
আজ বুধবার দায়িত্বভার গ্রহণের পর সুপ্রিম কোর্টে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, 'বিচারপ্রার্থী কে কখন হবে কেউ বলতে পারে না। আপনার ঘরে কখন ঝামেলা আসবে, আমার কখন ঝামেলা আসবে আমরা তো কেউ জানি না। আসলে আমাদের কোর্টের শরণাপন্ন হতে হয়।'
তিনি বলেন, 'কোর্টের শরণাপন্ন হলে এই বিচার বিভাগের শুধু আমরা যারা বিচারক আছি, তাদের দিয়েই কিন্তু বিচার বিভাগ না। আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন আইনজীবীরা, তাদের সহকারীরা। আমাদের সাব-অর্ডিনেট জুডিশিয়ারির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, রেজিস্ট্রার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং আরও অন্যান্য স্টাফ। সবাই যদি আন্তরিক হয় তাহলে বিচারপ্রার্থী মানুষের কষ্ট লাঘব হবে।'
মামলার জট প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'এই বিষয়টি পুরোনো, নতুন না। আমার কাছে ময়মনসিংহ জেলা জজশিপ থেকে একটি রায়ের কপি দিয়েছে আমাদের মিউজিয়ামে রাখার জন্য। শুনলে আপনারা অবাক হবেন, এটা ১৮৬১ সালের রায় কিন্তু মামলাটি শুরু হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। তখনো একটি মামলা শেষ হতে চার-পাঁচ বছর লেগেছে।'
'এখানে আমার মনে হয়, আইনের সংস্কার একটি বড় বিষয় এবং এই আইনি সংস্কারটি সরকার নিশ্চয়ই চিন্তা করবেন। মানুষের দুর্গতি কমানোর জন্য, কষ্ট লাঘবের জন্য আইনকে যুগোপযোগী করার মধ্য দিয়ে সম্ভব হবে নতুন করে মামলার ফাইলের সংখ্যা কমবে,' যোগ করেন তিনি।
ওবায়দুল হাসান আরও বলেন, 'এছাড়া এডিআর এবং মেডিয়েশনের মাধ্যমেও আমরা অনেক মামলা কমাতে পারি। কোর্টের বারান্দা থেকে মানুষকে ঘরে ফেরাতে পারি। তারা ঘরে বসে, বিচারালয়ে না গিয়ে একই রকম ফল অন্যভাবে পেতে পারেন বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে বা মেডিয়েশনের মাধ্যমে। সেগুলো বাংলাদেশে ডেভেলপ করছে ধীরে ধীরে। আমরা চেষ্টা করব এটাকে আরও গতিশীল করতে, যাতে মানুষকে আদালতমুখী খুব একটা না হতে হয়।'
মামলার জট সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। আপনার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে বিচার বিভাগে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী বলে মনে করেন—গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটিই (মামলার জট)। মামলার জট কমানোটাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটি জিনিস সেটা সারা বাংলাদেশেই আছে, সেটা হচ্ছে দুর্নীতি। এই দুর্নীতি ক্যানসারের মতো কাজ করছে সর্বত্র। এটা এমন না শুধু বিচার বিভাগেই আছে। এমন না যে, শুধু অন্য একটি ডিপার্টমেন্টেই আছে। সব জায়গাতেই কিছু না কিছু আছে। দুর্নীতি কমানোর ইচ্ছা থাকলে এটা কিছু না কিছু কমানো যাবেই। আমাদের পূর্বসূরীরা যেভাবে চেষ্টা করেছেন, আমি চেষ্টা করব আমার সহকর্মীদের নিয়ে এই দুর্নীতি যাতে কমানো যায়।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এভিডেন্সের অভাবে মামলা প্রমাণ হলো না; এটা এক জিনিস। আরেকটি হলো মামলাটি মিথ্যা। মিথ্যা যখন কোর্ট বলে তখন তার রেমিডি আছে। এ ধরনের হয়রানিমূলক মামলা মানুষ করে না তা না, হয়তো করে। এর থেকে পরিত্রাণের পথ হলো সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে। সামাজিক পরিবর্তন না আনলে শুধু বিচার করে, আইন-আদালত করে সমাজকে সঠিক পথে আনতে পারবেন না।'
গণমাধ্যমকর্মীদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিচার বিভাগ এটা আমি মনে করি না। বিচারকরা বিচারকদের কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের মতো করে। আমি শুধু একটি কথা বলবো, যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, আমাদের আইনজীবী বন্ধুরা যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন—তারা রাজনীতিটা করুন কিন্তু আদালন অঙ্গনে তারা যেন সহনশীলতার পরিচয় দেন। তারা যেন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। তাহলে এই উত্তাপগুলো আদালতে ছড়াবে না। সমাজের রাজনৈতিক বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমাদের মন্তব্য করা ঠিক হবে না এবং এটা আমার বিষয়ও না। আমাদের সামনে যখন বিচার আসে, কোনো একটি মামলা আসে, সেটা আমাদের এবং অধঃস্তন আদালতে নিষ্পত্তি করতে হয়।'
তিনি বলেন, 'আস্থার ঘাটতি সর্বত্রই আছে আমাদের। বিচার বিভাগের ওপরে আস্থার ঘাটতি নেই এ কথা আমি বলবো না। আমাদের ওপরে আস্থার যেটা আপনারা বলছেন, এখনো আপনার কোনো অসুবিধা হলে আপনি কোর্টেই যাবেন। আমাদের ডিসপোজালের রেট কিন্তু দিনের পর দিন বাড়ছে। মানুষের যদি আস্থাই না থাকবে, মানুষ কোর্টে আসবে কেন! আস্থা আছে বলেই মানুষ কোর্টে আসে। হ্যাঁ, তবে, আস্থা হান্ড্রেড পারসেন্ট আছে এ কথাটা আমি বলতে পারব না। এটা বলার মতো অবস্থায় আমরা নেই। যেমন আমি বলেছি, কোনো সেক্টর নেই যেটার ওপর মানুষের আস্থার কমতি হয়নি।'
'বিচার বিভাগের ওপর আস্থার কমতি যেটা হয়েছে, এটা শুধু বিচারকদের জন্য তা নয়। আমি বলেছি এটার অনুসঙ্গ অনেক। আইনজীবীরা আছেন, তাদের সহকারীরা আছেন, স্টাফরা আছেন। বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন মানুষ, সমাজে যেহেতু দুর্নীতির একটা প্রশ্ন আছে, সেই কারণে কখনো কখনো মানুষ মিসলিড হয়। তারা মিসলিড করে অনেক সময়; যারা আমাদের সঙ্গে অন্যান্যরা কাজ করেন, তারা। সেই কারণে কোনো কোনো সময় আস্থার যে অভাব হচ্ছে না—তা না। তাবে আস্থা নেই এ কথাটা আমি বলতে রাজি না। আস্থা আছে। আস্থার হয়তো কিছু কমতি আছে। এটা ধীরে ধীরে আমাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই এই আস্থাটা আমরা বাড়াতে চেষ্টা করব,' বলেন প্রধান বিচারপতি।
Comments