একাকিত্ব কাটিয়ে উঠার উপায়

ছবি: সংগৃহীত

মানুষ আদতে সামাজিক জীব, সঙ্গ তার চাই-ই চাই। নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বড় ভালো কোনো খবর এলো, অতি আনন্দের, কিন্তু তক্ষুণি কারও সঙ্গে সে আনন্দ ভাগ করে নেবেন– এমন সঙ্গ যদি না থাকে, আনন্দটা কেমন যেন ফিকে ঠেকে। মনের আকাশে দেখা দেয় ভীষণ ফ্যাকাশে ভাব।

২০২১ সালের ডিব ও ফস্টারের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ৩৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক সঙ্গীর অভাবে ভোগেন, ২৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বিচ্ছিন্ন অনুভব করেন এবং ১৬ থেকে ২৪ বছরের তরুণদের মধ্যে ৪০ শতাংশই বিভিন্ন সময়ে একাকিত্বের অনুভূতির মধ্য দিয়ে যান।

সঙ্গের এই সহজাত চাহিদা পূরণ না হলেই মানবজাতি ভোগে নিঃসঙ্গতায়। কেউ নিঃসঙ্গতার আখ্যান লেখেন, তো কেউ তাতে নিমজ্জনেই মেনে নেন ভবিতব্য। ওদিকে আশাবাদী দলের সদস্যরা এর সমাধান খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন।

এমনই কিছু সমাধান নিয়ে কথা বলা যায় আজ এই লেখায়।

 

সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা

নাগরিক এই জন-অরণ্যে অরণ্যের অভাব হলেও জনমানুষের কিন্তু একদম অভাব নেই। বরং দিন দিন পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে বৈ কমছে না। মনের সঙ্গে মনের মিল না হলে জনের মিল খুব একটা আকাঙ্ক্ষিত নয়, তবে সব সমাধানেরই প্রাথমিক ধাপ কিন্তু চেষ্টা। সেকথাও তো ভোলা চলবে না।

নিজের 'কম্ফোর্ট জোন' থেকে একটু বেরিয়ে আশপাশটা দেখুন। হয়তো একজনের সঙ্গে আপনার জমবে না বলে মনে হচ্ছে। তবু দুয়েকদিন দেখা করে, আড্ডা দিয়ে দেখুন। সবসময় কিন্তু 'ফার্স্ট ইমপ্রেশন'ই 'লাস্ট' হয় না। এভাবেই হয়তো একদিন 'পাইলেও পাইতে পারেন অমূল্য' সঙ্গী, নিঃসঙ্গ জীবনে যা কোনো রতনের চেয়ে কম নয় কোনোভাবেই।

তবে এক্ষেত্রে যে বিষয়টি নিয়ে সচেতন থাকতে হবে, তা হচ্ছে নিজের চাহিদা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। যেকোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্ক বা সঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যক্তির চাহিদা কী কী মাপকাঠির ভিত্তিতে গড়ে উঠছে এবং অন্য ব্যক্তির মধ্যে কোন কোন বিষয়গুলো সঙ্গের পরিপূরক হতে পারে, সেটি নিয়ে গভীরে অনুধাবন করা। এই 'কোপিং মেকানিজম'টি কাজে লাগিয়ে নিজের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে একাকিত্বেরও স্বরূপও স্পষ্ট হবে এবং তা থেকে প্রয়োজনমাফিক, সময়মতো বেরিয়ে আসার দুয়ারও খুলে যাবে।

অচেনার সঙ্গে পরিচয়

মানবমনের জটিলতা আকাশের নক্ষত্ররাজির চেয়েও গভীর নকশায় পরিপূর্ণ। তাই কখনো কখনো আমরা হয়তো শুধু সঙ্গই চাই, সম্পর্ক নয়। সেক্ষেত্রে কোনো ধরনের হিসেব-নিকেশ ছাড়া, অচেনা মানুষজনের সঙ্গে কথা বলাটা বেশ কার্যকর। হয়তো পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছেন কিংবা চা খেতে বেরিয়েছেন গলির মোড়টাতে, আপনারই মতো একা কেউ বসে আছে, সেক্ষেত্রে একটু কুশল বিনিময়, এদিক-সেদিকের খবর দেওয়া-নেওয়ার মতো তাৎক্ষণিক সঙ্গ দিয়ে দিতে পারে প্রত্যাশার চাইতেও বেশি কিছু।

প্রসঙ্গত বলা যায়, রাজেশ খান্না ও অমিতাভ বচ্চন অভিনীত বলিউডের বেশ পুরনো সিনেমা 'আনন্দ'র কথা। নামচরিত্র আনন্দকে প্রায়ই দেখা যায় রাস্তাঘাটে একজন 'মুরারীলাল'কে খুঁজে বেড়াতে। আসলে সেই মুরারীলালকে আনন্দ দেখেননি, জানেননি কোনোদিন। তবু তার কল্পনার এই নামকে সম্বোধন হিসেবে ব্যবহার করে যাকে ইচ্ছে তাকে ডেকে কয়েক মুহূর্তের আলাপন জমানোই তার শখ। পরে যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়, এমনটা তিনি কেন করেন– উত্তরে হাস্যোজ্জ্বল আনন্দ বলেন, 'কথা বলতে ইচ্ছে হলো, তাই বললাম!'

স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণ

যেকোনো ধরনের সামাজিক সেবামূলক কাজে অংশ নিলে কাজের তাগিদেই বহু নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং একটি সাধারণ উদ্দেশ্য থাকায় বন্ধনও দৃঢ় হতে থাকে। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের মধ্যে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, এরমধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই স্বেচ্ছাসেবার কারণে নিজেদেরকে আগের চেয়ে 'কম বিচ্ছিন্ন' বোধ করেছেন।  ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৬ হাজার মানুষের মধ্যে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম একাকিত্ব কমিয়ে আনতে সক্ষম।

পোষাপ্রাণীর সঙ্গ

পোষাপ্রাণীদের আমরা পেলেপুষে, খাইয়ে-দাইয়ে বাঁচিয়ে রাখছি আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও গভীরের চিত্রটা অন্য অর্থবহ। ব্যস্ত জীবনের মানসিক চাপ কমাতে কিংবা একাকী জীবনযাত্রায় একটি সঙ্গের নিদারুণ অভাব পূরণ করতে সক্ষম এই অবলা প্রাণীগুলো। সেটি খুশিতে লেজ নাড়ানো ছোট্ট কুকুরছানাই হোক বা খাবারে ভাগ বসাতে উদগ্রীব হয়ে থাকা বিড়াল। পোষা প্রাণীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রেখে থাকে।

নিজেই নিজের সঙ্গী

তবে একাকিত্বের সমাধান যে বের করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা কিন্তু নেই। যদি একাকিত্বকে কোনো ব্যক্তির কাছে সমস্যা বলেই না মনে হয়, তবে সেটি সমাধানের প্রশ্নও তো উঠছে না। নিজের সঙ্গে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারেন যারা, তাদের আসলে অন্য কোথাও সঙ্গ খুঁজে বেহাল হতে হয় না। নিজেকে চিনে নিয়ে, নিজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। তাই এবেলা নাহয় রবি ঠাকুরের সঙ্গে তাল তাল মিলিয়ে আহ্বান-বার্তা ভাসুক একা থাকার মরসুমে, 'তবে, একলা চলো রে!' 

 

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

2h ago