শিক্ষাজীবন থেকে কর্মজীবনে প্রবেশ

ইলাস্ট্রেশন: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

'যে সময় আপনি আপনার গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপ আকাশে ছুঁড়ে দেবেন, তখন থেকে আপনার দায় কেবলেই আপনার। তখন থেকে আর কাউকে কোনো দোষারোপ করার সুযোগ পাবেন না।'

একটি ইউটিউব ভিডিওতে শোনার পর থেকে এই কথাটি আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। স্নাতক করার সময়টা উচ্ছ্বাসের। এই সময়ে আমাদের মনে উত্তেজনা কাজ করতে থাকে যে কবে এই সময়টা শেষ হবে। সেইসঙ্গে এক ধরনের উদ্বেগও থাকে। স্নাতকের এই সময়টা যতটা সুখের, কর্ম জীবনের বাস্তবতা ততটা সুখের নাও হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করাটা খানিকটা কঠিনই বটে। সম্প্রতি স্নাতক হওয়া বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মী মাশেকুর খানের ভাষ্য, 'বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে পেশাগত জীবনে যাওয়ার শুরুটা হয় অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু চাকরির জন্য একের পর এক আবেদন করেও যদি চাকরি না পান, তখন দ্রুত হতাশা গ্রাস করে নেবে আপনাকে।'

মাশেকুরের মতো অনেক স্নাতক সম্পন্নকারীই চাকরি খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পাশাপাশি একের পর এক চাকরির আবেদন এবং সাক্ষাৎকার দিয়ে যাওয়াটাও তাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

সব চরাই-উৎরাই পেরিয়ে যিনি চাকরি পেয়ে যান, তার জন্যও কর্মক্ষেত্রের বাস্তবতা প্রত্যাশার সঙ্গে নাও মিলতে পারে।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যেসব পরিবর্তন আসবে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দৈনন্দিন জীবনের রুটিন নিয়ে খুব বেশি চিন্তা থাকে না। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, সারা রাত জেগে থাকা, ইচ্ছামতো আড্ডা দেওয়া—নানা ধরনের কাজে নিজেকে ইচ্ছা মতো ব্যস্ত রাখার সুযোগ থাকে। কিন্তু চাকরি জীবনে প্রবেশ করলে আটকে যেতে হয় নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে। বাংলাদেশে সাধারণত এই সময়ের গণ্ডি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। এই সময়ে অফিসে যাওয়ার সময় দেখতে পাবেন ট্র্যাফিকের চাপ। ঠিক সময়ে অফিস ধরতে হলে আপনাকে বেশখানিকটা সময় হাতে নিয়েই বের হতে হবে বাসা থেকে। যানজটের কারণে বাসায় ফেরার সময়ও লেগে যাবে অতিরিক্ত সময়। ৮ ঘণ্টা অফিস হলেও, এর জন্য যাতায়াতসহ দিনের প্রায় ১২ ঘণ্টা কেটে যাবে আপনার।

এমপাওয়ার সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী আজওয়াদ লাবিবা মহিউদ্দিন বলেন, 'আমার জীবনের রুটিনে বিরাট পরিবর্তন চলে এসেছে। এখন আর ভোররাত ৪টা পর্যন্ত জেগে থাকতে পারি না। সারা দিনে ৮-৯ ঘণ্টা অফিস করার জন্য যে পরিশ্রম হয়, তার জন্য অন্তত ৭ ঘণ্টা ঘুম জরুরি। আর কর্মজীবনে এই সত্যটাও মানতে হয় যে শুধুই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য অফিস থেকে ছুটি নেওয়া এক ধরনের বিলাসিতা।'

সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো যেন বহুল কাঙ্ক্ষিত। সপ্তাহের এই একটি দিনই যেন নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পাবেন। এরপর আবার ছয় দিন অফিস, আবার একদিনের ছুটি। এই পুনরাবৃত্ত রুটিনে মনে হতে পারে, জীবনে নতুনত্ব কিছুই নেই, যেমনটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। তখন হয়তো সেইসব বৈচিত্র্যময় দিন অনেক বেশি মনে পড়বে।

কোথাও চাকরি শুরু করার অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের মানুষের সঙ্গে কাজ করা। এর ফলে অভিজ্ঞ সহকর্মীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। তবে, প্রজন্মগত ব্যবধান থেকেই যায়।

একবার চাকরি জীবনে ঢুকে পড়লে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে সামাজিক জীবন ছোট হয়ে আসতে পারে। চারদিকে তাকালে দেখতে পাবেন, আপনার বন্ধুরাও সবাই ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে। তারাও চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, কিংবা বিদেশে চলে যাচ্ছে, এমনকি কাজের খাতিরে অনেক দূরের কোনো জেলায়ও চলে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেখা যাবে যে কর্মক্ষেত্রেই আপনার বন্ধুত্ব তৈরি হবে। কিন্তু, এই সম্পর্কে পেশাদারিত্বের খানিকটা বাধা থেকেই যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হওয়ার পর সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে দায়িত্বের পরিবর্তন। একজন শিক্ষার্থীর কাছে প্রত্যাশা থাকে সে পড়াশুনা ঠিকভাবে চালিয়ে যাবে। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ পড়াশোনা। কিন্তু, শিক্ষা জীবন শেষ হওয়ার পর এই নিরাপত্তা বেষ্টনী আর থাকে না। ভালো গ্রেড ও দক্ষতা থাকলে ভালো চাকরি পাবেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জীবন হবে না। তখন কাজ ও দায়িত্বের বিরাট বোঝা থাকবে কাঁধে। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হবেন যেটা দেখে সেটা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শিখেছেন তার খুব সামান্য অংশই কর্মক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কাজে আসছে। কারণ, তাত্ত্বিক জ্ঞান সাধারণত ব্যবহারিক জীবনে কম প্রয়োজন হয়। তাই, কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও ক্রমাগত শেখা এবং আত্ম-উন্নতি অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

হুয়াওয়ের সলিউশন আর্কিটেক্ট মুবাল্লিগ হোসেন বলেন, 'সদ্য পাশ করা একজন স্নাতকের জন্য কোনো খাতে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা খুবই কঠিন। তারা করপোরেট জীবন এবং এর অলিখিত আইনের জটিলতায় পড়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই সিনিয়ররা পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন, মানিয়ে নিতে না পেরে জুনিয়রদের উপেক্ষা করতে পারেন।'

আর্থিক প্রাপ্তির বিষয়টি সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। যদিও এটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশুনা শেষ করার পর অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক কর্মজীবনে এসে নতুন হিসেবে পছন্দসই বেতন নাও পেতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পাওয়ার জন্য যে অধ্যবসায় ও পরিশ্রম করেছেন, যে সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, সেগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে অনর্থক মনে হতে পারে। তবে, কাঙ্ক্ষিত বেতন নিশ্চিত করতে এ নিয়ে আলোচনা করার সময় আত্মবিশ্বাসী হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাণিজ্যের দুনিয়ায় যোগাযোগ ও শিষ্টাচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা কথা বলা বা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইনফরমাল থাকি। কিন্তু করপোরেট জগতে পরিষ্কার ও শিষ্টাচারপূর্ণ যোগাযোগই নিশ্চিত করতে পারে সফলতা।

বিএটি বাংলাদেশে কর্মরত তথ্য ও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে গ্র্যাজুয়েট রাইমা ইসলাম বলেন, 'কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রযুক্তিগত ও অন্যান্য দক্ষতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অনেক সঙ্গে যোগাযোগ, ভালো সম্পর্ক তৈরি ও তা বজায় রাখা।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রথম করপোরেট চাকরি কঠিন মনে হতে পারে। সেখানে হয়ত নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করবেন এবং কোনো যেন না হয় সেই চেষ্টা করবেন। তারপরও কাজ করতে গেলে নানান ভুল হয়েই যাবে। আর এগুলোই আপনার কর্মজীবনের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হবে, যা ভবিষ্যতের কাজে লাগবে।'

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আপনি একই চাকরি বা কর্মক্ষেত্রে হয়ত সারা জীবন থাকতে পারবেন না। তাই নেটওয়ার্কিং, বুঝে-শুনে ঝুঁকি নেওয়া, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনের লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

ফারনাজ ফাওয়াদ হাসান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English
NCP protest rally for election commission reform

NCP to hold protest rally in front of EC demanding its reconstitution

Calls on govt to hold local elections without delay

1h ago