ডলারের দর ১১১ টাকা শুধুই কাগজে-কলমে
চলতি মাসের শুরুতে ভোজ্যতেল শোধনাগার সমিতি রান্নার তেলের দাম বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে চিঠি দেয়।
সংগঠনটির যুক্তি—তারা ১১২ থেকে ১২৪ টাকা দরে প্রতি ডলার কিনে আমদানির জন্য অর্থ দিয়ে আসছিলেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ভোজ্যতেলের দাম ধরা হয়েছে প্রতি ডলার ১১১ টাকা দরে।
যেহেতু প্রতি ডলারের জন্য বেশি অর্থ গুনতে হচ্ছে, তাই ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে চান তারা।
চিনি শোধনাগার সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির জন্য এলসি খুলতে নানান জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে সমিতির সদস্যদের প্রতি ডলার ১২০-১২৩ টাকায় কিনে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা কমাতে ব্যাংকগুলো গত কয়েক মাস ধরে ডলারের যে বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছে সেই তুলনায় খোলা বাজারে ডলারের দাম অনেক বেশি।
ভোজ্যতেল ও চিনি শোধনাগারগুলোর মতো অন্যান্য খাতেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
ডলার ঘাটতির কারণে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে অসুবিধায় পড়ছেন। পরিস্থিতি এখন এমন যে, বেশি দাম দিতে চাইলেও প্রয়োজন মতো ডলার পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। এমনকি, ব্যাংক থেকেও এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।
ব্যাংক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, বড় ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খোলা ও বিল নিষ্পত্তিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেডা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নির্দেশনা হলো—ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে অভিন্ন বিনিময় হার মেনে চলতে হবে।
সেই হিসাবে আমদানির ক্ষেত্রে এক ডলার ১১১ টাকায় বিক্রি করার কথা।
কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই অন্যরকম।
আমদানিকারকদের সরকারি বিনিময় হারের তুলনায় বেশি টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে।
ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমদানির জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকে খোলা ১০ লাখ ডলারের এলসির বিপরীতে ১১ কোটি ১০ লাখ টাকার চেক দিয়েছি। একই সঙ্গে বাড়তি ৬০ লাখ টাকার চেক ব্যাংকে দিতে হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংক এক ডলারের দাম ১১১ টাকা ধরেছে। আরেকটি চেকের মাধ্যমে ৬০ লাখ টাকা দিতে হওয়ায় এলসি খুলতে ডলারপ্রতি দাম পড়েছে ১১৭ টাকা।'
'গত চার-পাঁচ মাস ধরে এমন ঘটনা ঘটছে। ব্যাংকের প্রস্তাব না মানলে এলসি হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে আমাদের এই ঘটনাটি খুঁজে বের করতে পারে,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হকও একই অভিজ্ঞতার কথা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন।
'আমরা ব্যাংকিং খাতে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা খাতে দুর্নীতির নতুন ব্যবস্থা দেখছি,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংক কর্মকর্তাদের যুক্তি হলো তারা খোলা বাজার থেকে ডলার কিনছেন। তাই এর দাম বেশি পড়ছে।'
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে না।'
দেশের অন্যতম শীর্ষ নিটওয়্যার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রপ্তানি আয়ের সঙ্গে আমদানির অর্থ সমন্বয় হওয়ায় রপ্তানিকারকরা তুলনামূলকভাবে সহজে এলসি খুলতে পারছেন।'
ব্যাংকের ভাষ্য
ব্যাংকগুলো বলছে যে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় দেশের রিজার্ভ কমছে।
এক বছর আগে দেশের রিজার্ভ ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার। গত ১৫ নভেম্বর তা কমে ২৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল ৬ অনুসারে, বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ১৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।
গত দেড় বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি শাখার প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রবাসী ও রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। ব্যাংকের পক্ষে কি ডলারপ্রতি ১০-১২ টাকা লোকসান দেওয়া সম্ভব?'
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কয়েকটি ব্যাংক লোকসান দিয়েও সরকার নির্ধারিত হারে ডলার কেনাবেচা করছে।
তারা আরও জানান, বিশেষ করে প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার পেতে অনেকে বেশি দাম দিচ্ছেন। সেই ডলার দিয়ে তারা গ্রাহকদের সেবা দেন।
অন্য এক বেসরকারি ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলা পর্যায়ে ছোট গ্রাহক ও আমদানিকারকদের এলসি খুলতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'চলতি মাসের শুরুতে বেশ কয়েকটি ব্যাংক এবিবি-বাফেডা নির্ধারিত ১১৫-১১৬ টাকার চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনেছে।'
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মনে হচ্ছে, কোনো প্রতিষ্ঠানই সততার সঙ্গে কাজ করছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ খেলায় যেন কোনো নিয়ম নেই। বাজার স্থিতিশীল করতে নিয়ম মেনে চলা জরুরি।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সংকট কাটানোর উপায়?
'সরকার নির্ধারিত হারে কেউ ডলার পাচ্ছেন না' উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডলার তখনই পাওয়া যায় যখন কেউ বেশি দাম দিতে চান। এটাই বাস্তবতা।'
তবে ভাসমান বিনিময় হারের সমর্থক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, 'এই মুহূর্তে ডলারের দাম ভাসমান না করাই ভালো। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে। নির্বাচনের পর কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'সুদের হার বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারকে খরচ কমাতে হবে। সরকারি খরচ মেটাতে টাকা ছাপানো উচিত না।'
প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হকও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে মত দেননি।
তিনি বলেন, 'আমি বিশেষজ্ঞ নই। তবে এটা সত্য যে, ডলারের দাম বাড়লে রপ্তানিকারকদের উপকার হয়। কিন্তু অর্থপাচার বন্ধ না করে টাকার মান বাজারভিত্তিক করা ঠিক হবে না। এমনটি হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।'
Comments