মুক্তিযুদ্ধে রাজবাড়ীর গণহত্যা

পুরো নয় মাস ধরেই রাজবাড়ীতে চলে হত্যাযজ্ঞ। রাজবাড়ীর অবাঙালিরা এতই শক্তিধর ছিল যে পুরো দেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও রাজবাড়ী শত্রু মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর।
রাজবাড়ীর স্মৃতিস্তম্ভ
রাজবাড়ীর স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭২ সালে সারা দেশ থেকে রাজবাড়ী জেলার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। এই জেলায় তখন প্রচুর বিহারির বসবাস ছিল। একেকটি বিহারি কলোনি ছিল একেকটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট।

সারাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় হত্যাকাণ্ড চালায়। তবে, রাজবাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মূলত যুদ্ধ হয়েছিল বিহারিদের।

রাজবাড়ীর বধ্যভূমিগুলোতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। চিহ্নিত করা গেছে বেশকিছু বধ্যভূমি। এর মধ্যে কিছু সংরক্ষণ করা হলেও অবহেলা আর অযত্নে রয়ে গেছে আরও বহু স্থান।

পুরো নয় মাস ধরেই রাজবাড়ীতে চলে হত্যাযজ্ঞ। রাজবাড়ীর অবাঙালিরা এতই শক্তিধর ছিল যে পুরো দেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও রাজবাড়ী শত্রু মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। বধ্যভূমিগুলোর তথ্য এবং স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে যদি এখনই উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে হয়তো সংরক্ষণের জন্য উপাদান পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে। এমনকি এক সময় এগুলো শুধু গল্পই হয়ে থাকতে পারে।

কালুখালী বধ্যভূমি, রাজবাড়ী

কালুখালী রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশের বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। এ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট (অব.) আকামত আলী মণ্ডল বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের সময় কালুখালী রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে একটি বড় খাল ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ওই খালে ফেলত।'

কালুখালীর মালিয়াট বধ্যভূমি

পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে কালুখালীর মালিয়াট বধ্যভূমিতে ফেলে রাখত।

লোকোশেড বধ্যভূমি, রাজবাড়ী

রাজবাড়ীর লোকোশেড এলাকা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে লোকোশেডের পুকুরে ফেলে দেওয়া হত।

তখন রাজবাড়ী রেলস্টেশন দিয়ে বেশ কয়েকটি ট্রেন চলাচল করত। ট্রেন রাজবাড়ী রেলস্টেশনে থামলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা বগিতে থাকা যাত্রীদের সন্দেহ হলে ধরে লোকোশেড ক্যাম্পে নিয়ে আসত। তারপর নির্যাতন করে হত্যার পর পুকুরে ফেলে দিত।

গোয়ালন্দের গণহত্যা

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দের উজানচরের বাহাদুরপুর ঘাটে আসে।

এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও সম্মিলিত জনতা তাদের বাধা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন আনছার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দিন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘাট দখল করে অদূরে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে প্রবেশ করে ২১ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

এরপর অবাঙালি বিহারি ও রাজাকাররা ব্যাপক লুটপাটের পর গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

ছোটভাকলার বালিয়াকান্দি গণহত্যা

ছোটভাকলার বালিয়াকান্দি গ্রামে ২৭ এপ্রিল বিহারি সাইদ, ইউনুছ, শামিমসহ ১৫ থেকে ২০ জনের সশস্ত্র একটি দল স্থানীয় জমিদার যামিনী রঞ্জন রায়ের বাড়িতে হামলা চালিয়ে জমিদারের শ্যালক হরেকৃষ্ণ, পার্শ্ববর্তী জমিদার মুহিত কুমার সাহার ছেলে মৃগেন্দ্র নাথ সাহা, জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া স্কুলপণ্ডিত পরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী ও পণ্ডিতের ভায়রাকে (অজ্ঞাত) গুলি করে হত্যা করে।

এরপর বিহারিরা জমিদার বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট চালায়। বিহারিরা চলে যাওয়ার পর রাত ১০টার দিকে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক আবদুল আজিজ শিকদার ও অনীল চন্দ্র বৈরাগী মরদেহগুলো জমিদার বাড়ির পেছনে গর্ত করে পুঁতে রাখেন।

তারাপুর ব্রিজ বধ্যভূমি, রাজবাড়ী

১৯৭১ সালের ২১ মে পাংশার বাবুপাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা নিরীহ ৩৬ জনকে হত্যা করে রেলব্রিজের নিচে পুঁতে রাখে।

পাংশার বধ্যভূমি সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা চাঁদ আলী খান বলেন, 'সেদিন ছিল ২১ মে। পাকিস্তান বাহিনী রেলগাড়িতে করে এসে নামে মাচপাড়া রেলস্টেশনে। এরপর পশ্চিম পাশে মথুরাপুর, কালিনগর ও রামকোল বাহাদুরপুর গ্রামে ঢুকে বাড়িঘর পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। তাদের সঙ্গে মিলিশিয়া, বিহারি, রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরাও যোগ দেয়। গ্রামগুলো থেকে ৩৬ জন নিরীহ মানুষকে ধরে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে তারাপুর রেলব্রিজের কাছে নিয়ে আসে। তাদের মধ্যে তখনো কেউ কেউ বেঁচে ছিলেন।'

'তখন ছিল বর্ষাকাল। ব্রিজের নিচ দিয়ে স্রোত বইছিল। নরপশুরা ওই ৩৬ জনের সবাইকে ব্রিজের নিচে ফেলে হত্যা করে। মাচপাড়া রেলস্টেশনের কাছে ইন্দারার মধ্যেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মানুষকে হত্যা করে ফেলে দেয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন এক ইউনিয়ন পরিষদের সচিব হরেন্দ্রনাথ সরকার।'

উজানচর গণহত্যা, রাজবাড়ী

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল গোয়ালন্দের উজানচরের বাহাদুরপুর ঘাটের প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন আনছার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দিন। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী ঘাট দখল করে অদূরে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে প্রবেশ করে গ্রামের ২১ জন নর-নারীকে গুলি করে হত্যা করে।

কল্যাণপুর গণহত্যা, রাজবাড়ী

কল্যাণপুরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ২৫ জন নিরীহ মানুষকে। বধ্যভূমিতে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস গণহত্যা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৮ মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিন ধরে চলা এই গণহত্যার স্বরূপ ছিল ভয়ঙ্কর। পরিকল্পিত পন্থায় বাঙালিদের খুন করা হয়েছে, গণহারে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়াসহ অপহরণ, গুম ও বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে।

কোলারহাটে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় নেওয়া একটি বাড়িকে স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়া হত রামকান্তপুর অস্থায়ী হাসপাতালে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করা জায়গাটি সংরক্ষণ করাও জরুরি।

Comments

The Daily Star  | English
quota reform movement,

Govt publishes preliminary list of those killed in July-August protests

The interim government today published a preliminary list of the people who died during the student-led mass protests in July and August.

1h ago