সংহতি সমাবেশে হাজারো জনতা

‘ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম পৃথিবীর সমস্ত মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম’

সমাবেশস্থলে ছিল প্রতিবাদী চিত্রাঙ্কন ও গাজায় গণহত্যার আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন। সেখানে দোলনার ওপর বসানো একটি মৃত শিশুর প্রতিকৃতি সবার নজর কাড়ে। পাশাপাশি প্রতিবাদী গান ও কবিতায় চলমান নৃশংসতার প্রতিবাদ জানান শিল্পীরা।
প্রতিবাদী মিছিলের অগ্রভাগ। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

ঢাকার শাহবাগে ফিলিস্তিন সংহতি সমাবেশ থেকে অনতিবিলম্বে গাজায় দখলদার ইসরায়েলিদের আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছে ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি, বাংলাদেশ।

আজ শুক্রবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই সমাবেশ শেষে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে একটি মিছিলও অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি শহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাব হয়ে নিউমার্কেট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়।

এছাড়া সমাবেশস্থলে ছিল প্রতিবাদী চিত্রাঙ্কন ও গাজায় গণহত্যার আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন। সেখানে দোলনার ওপর বসানো একটি মৃত শিশুর প্রতিকৃতি সবার নজর কাড়ে। পাশাপাশি প্রতিবাদী গান ও কবিতায় চলমান নৃশংসতার প্রতিবাদ জানান শিল্পীরা।

এই সমাবেশ ও মিছিলে দেশের প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, সিপিবি-বাসদসহ বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী এবং নারী-শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। ছিলেন ঢাকায় অবস্থানরত দুজন ফিলিস্থিনি শিক্ষার্থীও।

ছবি: স্টার

প্রতিবাদী সমাবেশের আলোচনা পর্বে সমাবেশের আয়োজক ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'ফিলিস্তিনের মানুষদের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রাম আমাদেরও সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম পৃথিবীর সমস্ত মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম।'

সভাপতির বক্তব্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই ইসরায়েলিদের পূর্বপুরুষরা হিটলারের যে নৃশংস বর্বরতা দেখেছে, যে হলোকাস্ট দেখেছে সেটা তারা ভুলে গেছে। এবং সেই হলোকাস্ট তারা এখন ফিলিস্তিনিদের ওপরেই চালাচ্ছে। এর নিন্দা আমরা করব। কিন্তু আমরা জানব এর মীমাংসা কেবল নিন্দা দিয়ে হবে না।'

এই অধ্যাপকের অভিমত, 'প্রত্যেকটা দেশেই মানুষকে সামাজিক বিপ্লবের দিকে যেতে হবে। সেই সামাজিক বিপ্লব যদি প্রত্যেকটা দেশে ঘটে তাহলেই পুঁজিবাদের পতন হবে, সাম্রাজ্যবাদের পতন হবে এবং তখন দেখা যাবে ইসারায়েল বলে কোনো রাষ্ট্র নেই। বর্ণবাদী কোনো রাষ্ট্র নেই। প্রতিবেশী ভারত যে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ছে, সেটাও নেই।'

ছবি: স্টার

সমাবেশের শুরুতে ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদানের পাঠানো বক্তব্য পাঠ করেন চৌধুরী মুফাদ আহমেদ।

বক্তব্যে রামাদান বলেন, 'ফিলিস্তিনি জনগণের ত্যাগ যত বড়ই হোক না কেন এবং যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংসস্তূপে তারা যতদিন যন্ত্রণা ভোগ করুক না কেন, সার্ববৌমত্ব ও স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।'

ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য সব বাংলাদেশিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, 'ফিলিস্তিনে আপনার ভাই-বোনদের পরিত্যাগ করবেন না। কারণ আপনারা তাদের সহায় এবং তারা আপনাদের সহায়। বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের সরকার সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে তারা আমাদের সমর্থক এবং সহায়তাকারী।'

ছবি: স্টার

সমাবেশে ফিলিস্তিন সংহতি কমিটির ঘোষণা পাঠ করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, 'ইসারায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষের প্রতিবাদ ও সংহতি কর্মসূচি এই সময়ের বিশ্বে সবচাইতে আশাব্যাঞ্জক ঘটনা। রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের পার্থক্য এখানে স্পষ্ট হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো ইসায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সেসব দেশের সর্বস্তরের মানুষ নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে।'

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, 'আমরা আরও লক্ষ্য করছি যে, একদিকে যেমন অনেক মুসলিম প্রধান দেশে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সক্রিয়ভাবে দাঁড়াচ্ছে না, আবার বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে খ্রিষ্টান-ইহুদিসহ বিভিন্ন ধর্ম ও মতাবলম্বীরা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের প্রতিবাদে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এগুলো এটাই স্পষ্ট করে যে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলি জুলুম, গণহত্যা দখলদারিত্ব আর তার বিরুদ্ধে লড়াই কোনো ধর্মীয় বিরোধের বিষয় নয়। এই লড়াই সাম্রাজ্যবাদী, ফ্যাসিবাদী, দখলদার, জালেম অপশক্তির বিরুদ্ধে সকল ধর্ম-বর্ণের মুক্তিকামী মজলুম বিশ্ব মানবতার লড়াই।'

ছবি: স্টার

সমাবেশের ঘোষণায় চার দফা দাবির কথা জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক। দাবিগুলো হচ্ছে—ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদার ইসরায়েলিদের আগ্রাসন ও গণহত্যা অনতিবিলম্বে বন্ধ করা, ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণের পরিপূর্ণ অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের উভয় অংশের মানুষের জান-মাল-জীবন-জীবিকা-নিরাপত্তা ও পরিপূর্ণ মানবাধিকার এবং মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা করা, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন চুক্তি, প্রস্তাব ও শর্তের মানদণ্ড অনুযায়ী স্বাধীন ও সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ়, স্বচ্ছ ভূমিকা নেওয়া।

সবাবেশের আলোচনা পর্ব শুরুর আগে প্রতিবাদী গান পরিবেশন করে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, কিম্ভূত, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বিবর্বন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। কবিতা পাঠ করেন হাসান ফখরি, বেলায়েত হোসেন। 'ফুলগুলি কোথায় গেল' শীর্ষক নাটক পরিবেশন করে নাট্যদল বটতলা।

সমাবেশ শেষে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শুরু হওয়া মিছিলের অগ্রভাগে ছিল দোলনায় রাখা ওই মৃত শিশুর প্রতিকৃতি; এর দুই পাশে ছিল ফিলিস্তিন ও বাংলাদেশের পতাকা।

Comments