ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ কি ছড়িয়ে পড়ছে?

সবচেয়ে শক্তিশালী ও ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও প্রকৃত সরকারহীন রাষ্ট্র ইয়েমেনে হামলা চালায় তখন তা আরও একটি অসম ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ইঙ্গিতই দেয় কি?
হুতি
ইয়েমেনে ইঙ্গ-মার্কিন হামলার পর হুতিদের সমর্থনে সানায় স্থানীয় অধিবাসীদের সশস্ত্র মহড়া। ১৪ জানুয়ারি ২০২৪। ছবি: রয়টার্স

এক এক করে ১০০ দিনের বেশি পার হলো ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের। এ সময়ের ভেতর প্রায় ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের অবরুদ্ধ গাজায় লাগাতার হামলা চালিয়েও সামরিক দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ইসরায়েল মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইতি তো টানতেই পারেনি, বরং এখন শঙ্কা—এই যুদ্ধ আরও বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে না তো?

সবচেয়ে শক্তিশালী ও ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও প্রকৃত সরকারহীন রাষ্ট্র ইয়েমেনে হামলা চালায় তখন তা আরও একটি অসম ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ইঙ্গিতই দেয় কি?

যুদ্ধে জড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য?

গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবি জানিয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেয় প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। তারা ইসরায়েলকে বাণিজ্যিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে লোহিত সাগর দিয়ে ইসরায়েলগামী বা ইসরায়েলের মালিকানাধীন জাহাজে হামলার হুমকি দিলেও মূলত সব জাহাজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এর প্রভাব পড়ে বিশ্ব বাণিজ্যে।

হুতি
ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখলের বার্ষিকী উদযাপনে হুতিদের কুচকাওয়াজ। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের প্রতি সার্বিক সমর্থন জানানো যুক্তরাষ্ট্র 'লোহিত সাগরে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা'র লক্ষ্যে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্যকে নিয়ে হুতিদের ওপর হামলা চালায়। এরপর হুতিরা এই দুই দেশের ওপর প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করে।

এরপর গত শনিবার হুতিদের ওপর দ্বিতীয়বার হামলা চালানো হয়।

রয়টার্স জানিয়েছে—প্রতিশোধের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, 'হুতিরা আমাদের মিত্রদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ চালিয়ে গেলে আমরা এর জবাব নিশ্চিত করব।'

হামলার নির্দেশ তিনিই দিয়েছেন উল্লেখ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, 'আমাদের লোকজনকে রক্ষা ও অবাধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনে পরবর্তী ব্যবস্থার নির্দেশ দেব।'

হুতি
সানায় হুতিদের কুচকাওয়াজে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

এই হামলাকে 'আত্মরক্ষামূলক' অভিহিত করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রিশি সুনাক বলেছেন, 'এর লক্ষ্য উত্তেজনা কমানো ও সেই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।'

হুতিদের ওপর হামলাকে স্বাগত জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জার্মানি। দেশটি মনে করে 'শান্তি রক্ষায়' তাদের কাজ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পাশে দাঁড়ানো।

তবে এ কথা সবাই জানেন যে 'স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা'র লক্ষ্যে চলতি শতকের শুরুর দিকে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে নিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ইয়েমেনে হয় কিনা এখন সেটাই দেখার বিষয়।

বাড়ছে যুদ্ধের পরিধি?

ইসরায়েলে হামাসের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গাজায় দেশটির নির্বিচার হামলার শুরু থেকে লেবাননের সঙ্গে এর সীমান্ত-সংঘাত অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে যায়। দক্ষিণ সীমান্তে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইসরায়েলকে এর উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহর দিকেও লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে।

ইসরায়েল হামাস ও হিজবুল্লাহকে দীর্ঘ ধরে মোকাবিলা করলেও এখন তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে হুতি গোষ্ঠী; যাদের সঙ্গে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তেল আবিবের নেই।

হুতি
ইয়েমেনে অস্ত্র হাতে হুতি সমর্থক। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

গত ১৫ ডিসেম্বর ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস'র এক সংবাদের শিরোনামে বলা হয়, 'উত্তপ্ত লোহিত সাগর: সবে তো শুরু'।

এরপর বিশ্ববাসী লোহিত সাগরকে এতটাই উত্তপ্ত হতে দেখে যে তা 'শীতল' করতে বিশ্বের দুই পরাশক্তিকে সামরিক অভিযানে নামতে হয়েছে।

হুতি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার পরদিন গত শুক্রবার জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন—'যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায় না মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ুক।'

দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ সমন্বয়ক জন কিরবি সিএনএন'কে বলেছেন, 'আমরা যা করছি, আমরা যা করার চেষ্টা করছি তা হলো সংঘাত যেন ছড়িয়ে না পড়ে।'

হুতিদের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ইয়েমেনের ২৮ এলাকায় ৬০ লক্ষ্যবস্তুতে ইঙ্গ-মার্কিন হামলায় সংগঠনটির পাঁচ যোদ্ধা নিহত হয়েছেন।

হুতি
লোহিত সাগরে হুতিদের হাতে আটক পণ্যবাহী জাহাজ গ্যালাক্সি লিডার। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা'র বরাত দিয় সিএনএন জানিয়েছে, গত রোববার প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হুতিদের ওপর হামলাকে 'আগ্রাসন' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে হুতিদের শীর্ষ রাজনৈতিক পরিষদের প্রধান মাহদি আল-মাশাতের সঙ্গে কথা বলেছেন।

গত রোববার ইরানের অপর সংবাদ সংস্থা ইসনা'কে তেহরানে হুতি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেন সরকারের রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম মোহাম্মদ আল-দেইলামি বলেন, 'আমেরিকানরা এই অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ খুঁজছে। আমরা তাদেরকে এমন বোকামি না করতে সতর্ক করছি।'

'লোহিত সাগরে যাই ঘটবে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী' বলেও মন্তব্য করেন আল-দেইলামি।

যুদ্ধের ঝুঁকিতে সিরিয়া, ইরাক ও লেবানন

গত শনিবার লেবাননের হিজবুল্লাহ-ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম আল মায়াদিনের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানিয়েছে—গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে ইরান-সমর্থিত 'প্রতিরোধ বলয়'-এর যোদ্ধারা এখন পর্যন্ত সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন সেনাদের ওপর অন্তত ১৩০ বার হামলা করেছে।

নাম প্রকাশ না করা এক মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরাকে হামলা হয়েছে ৫৩ বার ও সিরিয়ায় ৭৭ বার। আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসকে দমনের উদ্দেশ্যে ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি আছে।

হুতি
গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় বিক্ষোভ সমাবেশ। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ইরাকের মার্কিনবিরোধী ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স সংগঠনটি সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দাবির একদিন পর এমন তথ্য পাওয়া গেল। এই সংগঠনটি ইসরায়েলেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দাবি করলেও কোনো ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ জানা যায়নি।

ইয়েমেনে হামলার প্রতিবাদে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরআব্দুল্লাহিয়ান বলেছেন, 'হোয়াইট হাউস এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে কেবল ইসরায়েলের সঙ্গে সব সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে।'

এটি এমন বাস্তবতায় সম্ভব নয় বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাই আবারও প্রশ্ন জাগে, যুদ্ধ কি ধীরে ধীরে ছড়িয়েই পড়ছে?

লক্ষ্য ইরান?

মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমের দেশগুলো ইরানকে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করে। ইউরোপ-আমেরিকার বন্ধু ইসরায়েল এই দেশটিকে মনে করে তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি। পশ্চিমের নেতারা হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের প্রসঙ্গে কিছু বলার সময় তাদেরকে ইরান-সমর্থিত আখ্যা দেন। এখন প্রশ্ন—এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী দমনে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের হামলা ইরান পর্যন্ত গড়াবে কি?

হুতি
বাগদাদ বিমান বন্দরে মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানির ছবি নিয়ে এক সশস্ত্র হুতি সমর্থক। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

গত শনিবার হুতিদের ওপর দ্বিতীয়বারের হামলার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি। তবে এই হামলার পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন হুতিদের নিয়ে ইরানকে 'ব্যক্তিগত' বার্তা দিলেন বলে মন্তব্য করেছেন।

একই দিনে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়, হুতিদের ওপর পশ্চিমা জোটের হামলা 'হিতে বিপরীত' হতে পারে। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক এলিজাবেথ কেনডাল মনে করেন, হুতিদের ওপর হামলা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে।

সংবাদমাধ্যমটিকে তিনি আরও বলেন, 'যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে হুতিরা এমন হামলার সঙ্গে বহু বছর ধরেই পরিচিত। গত নয় বছরে তারা সৌদি নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর অন্তত ২৫ হাজার বিমান হামলা মোকাবিলা করে টিকে আছে।'

হুতিরা ইরাক ও আফগানিস্তানে পশ্চিমা জোটের পরিণতি সম্পর্কে জানে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এই সংঘাত লোহিত সাগরের আশপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষদের কাছে হামাস ও হুতিরা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।'

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ কথা বলা যায় যে, গত ১০০ দিনেও যখন ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শেষ হয়নি, তখন হুতিদের ওপর হামলা তা আরও ছড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কাই যেন তৈরি করছে।

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

16h ago