ফতেহ আলী চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অজর-অমর এক নাম

ক্র্যাক প্ল্যাটুনের হয়ে ঢাকার প্রায় সবগুলো গেরিলা অপারেশনে অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়া ৭৫ বছরের এই যোদ্ধার কণ্ঠ থেমে গেছে চিরকালের জন্য। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর আশপাশের এলাকাগুলো থেকে ঢাকায় ঢোকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগামী দলে ছিলেন ফতেহ আলী চৌধুরী। ১৭ ডিসেম্বর সকালে রেডিওতে এবং বিকালে টেলিভিশনে ওই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের করণীয় সম্পর্কে কথা বলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকায় মুহুর্মুহু গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়া কিংবদন্তি ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সে সময় ক্র্যাক প্ল্যাটুনের হয়ে ঢাকার প্রায় সবগুলো গেরিলা অপারেশনে অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়া ৭৫ বছরের এই যোদ্ধার কণ্ঠ থেমে গেছে চিরকালের জন্য। গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যু হওয়া এই যোদ্ধার মরদেহ রাখা আছে হিমঘরে। মেয়ে দেশের বাইরে থেকে ফিরলে তার দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নিউমোনিয়ার পাশাপাশি বার্ধ্যক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র থাকাকালে ফতেহ আলী চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তার সহযোদ্ধা ও ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক জানান, ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের প্রায় সব অভিযানের অংশ ছিলেন তিনি।

সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার সম্পাদনায় সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত 'ভুলি নাই ভুলি নাই' শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থের একটি লেখায় ফতেহ আলী চৌধুরী সে সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'ষাট দশকের শেষভাগে বিশ্বময় তারুণ্যের জোয়ার। ঢাকাও উত্তাল তারুণ্যের পদভারে কম্পিত। '৭১ সাল যেন খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে গেল আমাদের কাছে। '৭১ সালে যখন খালেদ ও হায়দারের সেক্টর টু-য়ের ক্যাম্পে পৌঁছালাম তখন দেখা হয় নতুন করেই পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। সত্যি যেন মনে হলো আমরা সবাই এসে গেছি, কেউ বাকি নেই।'

ফতেহ আলী চৌধুরীর আর তার দুই ভাই সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী ও ডা. মোরশেদ চৌধুরীও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের মধ্যে শাহাদত চৌধুরী নিজেও ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। মোরশেদ চৌধুরী আগরতলার মেলাঘরে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে আহত মৃুক্তিযেদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। তিন ভাইই ছিলেন ২ নম্বর সেক্টরের আওতায়। ঢাকার গেরিলাদের অনেকেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের হাটখোলার বাসা থেকে। ২৯ আগস্ট ঢাকার গেরিলাদের ধরতে ঢাকার যে জায়গাগুলোতে অভিযান চালায় পাকিস্তানি বাহিনী, তার মধ্যে ওই বাসাটিও ছিল। সেখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করে পাকিস্তানি সেনারা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর আশপাশের এলাকাগুলো থেকে ঢাকায় ঢোকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগামী দলে ছিলেন ফতেহ আলী চৌধুরী।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। টেলিভিশনে মুক্তিযোদ্ধাদের করণীয় সম্পর্কে বলছেন ফতেহ আলী চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

হাবিবুল আলম বীর প্রতীক জানাচ্ছেন, ১৭ ডিসেম্বর রেডিওতে যে ঘোষণাটি পাঠ করেন ফতেহ আলী চৌধুরী, সেটাও লিখেছিলেন তার বড় ভাই শাহাদত চৌধুরী ও কাদের মাহমুদ।

মুক্তিযুদ্ধে ফতেহ আলী চৌধুরী একটি চাইনিজ এসএমজি ব্যবহার করতেন। তিনি নিজেই সে সম্পর্কে লিখেছেন, 'অন্য গেরিলাদের কাছে অস্ত্রটির জন্য আমি ছিলাম ঈর্ষার পাত্র।'

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ঢাকায় অবস্থান নিলেও ২৯ আগস্ট এখানকার সবগুলো ইউনিট ধরা পড়ে পাকিস্তানি আর্মির হাতে। এদের মধ্যে ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, জুয়েল, বাকের, বদি, আজাদ ও সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ আরও অনেকে। এই ঘটনার পর বাকিদের মেলাঘর হেডকোয়ার্টারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ঢাকায় পাঠানো হয় নতুন দল। পরে নভেম্বরের শুরুতে বিচ্ছিন্ন দলগুলোকে একত্রিত করে আবার ফিরে আসেন ফতেহ আলী চৌধুরীরা। অবস্থান নেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কোলঘেঁষা ইছাপুরা গ্রামে।

ফতেহ আলী চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৯ সালে। স্বাধীনতার পর তিনি সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ও সরকারি তোলারাম কলেজে শিক্ষকতা করেন। বাংলাদেশ শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনেও কর্মরত ছিলেন তিনি। ছিলেন সিএসএলের পরিচালক।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ও ফতেহ আলী চৌধুরীর ভগ্নিপতি শাহরিয়ার কবির ফতেহ আলী চৌধুরীকে অভিহিত করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তিনি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নাগরিক আন্দোলনের শুরু থেকে নির্মূল কমিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে তিনি যুক্ত ছিলেন।

ফতেহ আলী চৌধুরীর কথা উঠে এসেছে ক্র্যাক প্লাটুনের আরেক সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার স্মৃতিচারণাতেও। তিনি তার এক লেখায় বলছেন, '১৯৭১-এর ২৫ মার্চের গণহত্যার পর কর্তব্য স্থিরে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধে যাবো। যোগাযোগ করলাম বন্ধুদের সঙ্গে। ফতেহ আলী, সাঈদ উলফত, পুলু, মিলু, রূপু, গাজী দস্তগীরসহ ১৬ জন বন্ধু একযোগে সিদ্ধান্ত নিলাম অস্ত্র তুলে নেবার। আমাদের মধ্যে একটা নিজস্ব শপথ গ্রহণ হয়েছিল যে যুদ্ধে আমরা সকলেই এক সঙ্গে থাকব। তারুণ্যের আবেগেই আমরা এমন শপথ নিতে পেরেছিলাম।'

'চোখের দেখা প্রাণের কথা…' শিরোনামের আরেকটি লেখায় ফতেহ আলী চৌধুরীও স্মরণ করেছেন সেই বন্ধুদের কথা। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, 'হারিয়ে গেছে আমার সহযোদ্ধারা অনেকেই আমাদের জীবন থেকে। খুব জানতে ইচ্ছে করে তোমরা কোথায়, কেমন আছ তোমরা। আর তোমাদের বলতে ইচ্ছে করছে—'হি হু ফাইটস টুডে/অ্যান্ড রানস অ্যাওয়ে/লাইভস টু ফাইট/অ্যানাদার ডে।'

সত্যিকারের যোদ্ধারা হয়তো এভাবে লড়াইয়ের জন্যই বেঁচে থাকেন। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে ফতেহ আলী চৌধুরীর নশ্বর দেহ আর ফিরে আসবে না। কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশ নামের নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ায় যে লড়াইয়ের দাগ রেখে গেছেন এই যোদ্ধা, তা অক্ষয়, অজর।

  

Comments

The Daily Star  | English

Technical education hit by teacher shortage, falling enrolment

Bangladesh’s technical education sector is facing a slow-burning crisis, shaped by a severe shortage of teachers, poor infrastructure, and steadily declining student interest.

10h ago