অঞ্চলভেদে দেশে গরু-খাসির মাংস রান্নায় যত বৈচিত্র্য
বাংলাদেশের খাদ্যভাণ্ডার এতটাই সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় যে, মনে হয় যেন মশলাপাতি আর উপকরণ প্রতিবারই একেকটি নতুন স্বাদ খুঁজে আনে। আর তাইতো স্টার লাইফস্টাইলের আগ্রহ তৈরি হয় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বিচিত্র 'রেড মিট ডিশ' খুঁজে বের করতে। দীর্ঘ অভিযানের পর আমরা খুঁজে এনেছি দারুণ সব খাবার, সেইসঙ্গে সেগুলোর অদ্ভূত সব শেকড়ের গল্প।
আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম শুধু আঞ্চলিক বিশেষ রান্নাগুলোই তুলে আনব, কিন্তু অনেক ভাবনা-চিন্তার পর তা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এরপর আমরা যখন জনপ্রিয় 'রেড মিট ডিশ' নিয়ে ভাবি, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় কিছু চেনা নাম– বিফ হালিম, নেহারি, চাপ, কোফতা কাবাব, চিরকালীন প্রিয় ঝুরা মাংস, মুখের মধ্যে দিলেই গলে যাওয়া মাটন কষা– সেই তালিকার কি আর শেষ আছে! পুরো দেশ জুড়েই এই রান্নাগুলো হয় এবং সবাই তৃপ্তি করে খায়। কিন্তু খাবারগুলো আদিকথা খুঁজে বের করে একটি অঞ্চলের সঙ্গে নাম জুড়ে দেওয়াটা এত সহজ ছিল না।
তাই তো খিদেপেটে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম বাংলাদেশের খাদ্যভাণ্ডারকে বৈচিত্র্যময় করে গড়ে তোলা বিভিন্ন সুস্বাদু রান্না ও তার প্রণালির খোঁজে। দেখা যাক, কী মণিরত্ন খুঁজে পেলাম!
ঢাকাবাসীদের কাচ্চি বিরিয়ানির প্রতি প্রেম তো আর নতুন কিছু নয়। আমাদের এই ম্যাপে বিশেষ স্থান নিয়ে আছে তাই বিভিন্ন স্বাদের ঢাকাইয়া কাচ্চি।
ঢাকার মতোই চট্টগ্রামেও রয়েছে বেশ কিছু বিশেষ নাম। এর মধ্যে সবার উপরে আছে কালা ভুনা, চানার ডাল, গরুর মাংস এবং আখনি বিরিয়ানি, যার সঙ্গে সিলেটের আখনি পোলাওর বেশ একটা ভালো মাখামাখি সম্পর্ক রয়েছে!
কিন্তু এসব সহজ খাবারের নাম তো একটুখানি নেট ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। তাই আমরা গবেষণার পরের ধাপে চলে গেলাম। আমরা এবার চলে গেলাম পুরোপুরি গোয়েন্দার ভূমিকায়। দিনভর অগণিত ফোনকলের মাধ্যমে ডেইলি স্টারের বহু স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে সেসব অঞ্চলের রেস্তোরাঁ, বাবুর্চি এবং আরও বহু লোকের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে গেলাম।
রাজধানী ছেড়ে এবার আমরা গাজীপুরের দিকে ঝুঁকলাম, আর সেখানে মিলল কাঁঠাল দিয়ে গরুর মাংসের এক বিশেষ তরকারি। যদিও এই রান্নাটি দেশজুড়েই মোটামুটি বিখ্যাত, তবে গাজীপুরে কাঁঠালের জনপ্রিয়তা বেশি হওয়ায় এখানকার বাসিন্দারা প্রজন্মান্তরে এই পুরোনো রেসিপিটিকে দিন দিন আরও পাকাপোক্ত করে চলেছে।
আর চায়ের রাজধানী সিলেটে তো নামডাকওয়ালা সাতকরা দিয়ে গরুর তরকারি রয়েছেই। এটি এ অঞ্চলের খাদ্যভাণ্ডারের একেবারে মুকুটবিহীন রাজা। এদিকে সুনামগঞ্জে পাওয়া গেল আরেক মজার খাবার, মাংসের পিঠা।
বরিশাল মাছের রান্নার জন্য আগে থেকেই বিখ্যাত, সেখানে পাওয়া গেল দুইভাবে তৈরি গরুর মাংসের রেসিপিও। একটি সরিষার তেল ও টমেটো সসের মিশেলে দারুণ একটি তরকারি এবং অপরটি কাঁচা পেঁপের সতেজতায় উনুনে চড়ানো মাংসের ঝোল।
রাঙামাটিতে আবার গরুর মাংসের চামড়া দিয়েও ঝোল করা হয়, এ কথা শুনে তো চোখ কপালে ওঠার হাল! জানা যায়, স্থানীয়দের মধ্যে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবার।
এ ছাড়া খোঁজ পেয়েছি রাজশাহী জেলার, বিশেষত রাজশাহী শহর, বগুড়া ও নওগাঁর অন্যতম জনপ্রিয় রান্না গরুর মাংসের আলু ঘাটির।
অবশ্য আমাদের সবচাইতে মজার আবিষ্কারের একটি ছিল রংপুরের জনপ্রিয় স্ট্রিটফুড বট খিচুড়ি। গরুর বট ঝাল ঝাল ঝোল খিচুড়ির সঙ্গে বিক্রি করা হয় এখানে।
নামে খুব বেশি আকর্ষণীয় না মনে হলেও স্বাদের বিস্ফোরণে সবসময়ই মন কেড়ে নেয় চুইঝাল। খুলনার চুইঝাল সম্প্রতি দেশজুড়েই খ্যাতি পেয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনারা জানেন কি, খুলনাতে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় খাসির চুইঝাল? এছাড়া বাঁধাকপি দিয়ে গরুর মাংস আবার রেস্তোরাঁর চাইতে এ অঞ্চলের বাসাবাড়িতে বেশি রান্না করা হয়।
একটি বিষয় সত্যি যে, আমাদের গবেষণায় গরুর মাংসের রান্নাই বেশি উঠে এসেছে। এটি হয়তো আমাদের দেশে গরুর মাংসের জনপ্রিয়তার কারণেই। তবে আটা ডাল গোশত, চুইঝাল এবং সর্ষের তেলে রান্না মাংসের মতো আরও অনেক রেসিপিতে গরুর মাংসের পাশাপাশি খাসিও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
খাবার খোঁজার এই উপভোগ্য যাত্রায় আরও পাওয়া গেছে টাঙ্গাইল, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ এবং দেশের অন্য আরও অনেক জেলায় জনপ্রিয় একটি ঘরোয়া খাবারের খোঁজ, যার নাম মিল্লি/মেন্দা ভাত। সব অঞ্চলেরই নিজস্ব স্পর্শ আছে এই খাবারটির মধ্যে, কিন্তু মূল উপাদানগুলো একই থাকে– ডাল ও ভাতের সঙ্গে রান্না করা ঝুরা বা কিমা মাংস (সাধারণত গরু কিংবা খাসি)।
রন্ধনশৈলীর এ অভিযান শুরু হয়েছিল যে উদ্দেশ্য নিয়ে, চলতি পথে আমাদের অর্জন ছিল এর চাইতেও অনেকগুণ বেশি। এতে করে আমাদের একেবারে নিজস্ব এবং বিচিত্র সব রান্নার খোঁজ পাওয়া গেছে, যার একেকটির শেকড় গাঁথা একেকটি অঞ্চলে। তাই আবার যখন বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেরিয়ে যাবেন, তখন ভুলবেন না অঞ্চলভেদে বিশেষ সব রান্না চেখে দেখতেও।
বাংলাদেশি রেড মিট ডিশের এই মানচিত্রটি তৈরি করতে পর্যাপ্ত দিক-নির্দেশনা ও সহায়তার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক উদয় শঙ্কর বিশ্বাস এবং ইউনাইটেড গ্রুপের ইন্ডালজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কনসালটেন্ট শেফ শুভব্রত মৈত্রকে। এ ছাড়াও দেশজোড়া রাঁধুনি, স্থানীয় অধিবাসী এবং আমাদের সব সহকর্মীর প্রতিও রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments