জেলা হাইটেক পার্ক প্রকল্পে ৭ বছরে অগ্রগতি মাত্র ১৪ শতাংশ
সাধারণত বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগে। কিন্তু জেলা পর্যায়ে হাইটেক পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের গতি যেন একটু বেশিই শ্লথ। যা দেখে মনে হতে পারে, সরকার স্মার্ট জাতি গঠন ও ডিজিটালাইজড বিশ্বের জন্য শ্রমশক্তি প্রস্তুতের যে লক্ষ্য নিয়েছে তা অর্জন করা কষ্টসাধ্য হতে পারে।
এর আগে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে দেশের বিভিন্ন জেলায় ১২টি হাইটেক পার্ক নির্মাণে এই প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। উদ্দেশ্য ছিল, দেশে-বিদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা।
কিন্তু সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাত বছর পর প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাজেটের ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ ব্যয় করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, 'জেলা পর্যায়ে আইটি পার্ক/হাইটেক পার্ক স্থাপন (১২ জেলা)' প্রকল্প বাস্তবায়নে দরকারি ১ হাজার ৭৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার মধ্যে ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা আসছে ভারত থেকে। বাকি টাকা দেবে বাংলাদেশ।
পার্কগুলো খুলনা, বরিশাল, রংপুর, নাটোর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, জামালপুর, গোপালগঞ্জ, ঢাকা ও সিলেটে নির্মাণ করা হবে।
শুরুতে আইসিটি বিভাগের এক নথিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ওই সময়সীমার মধ্যে তা করতে না পারায় সরকার প্রকল্পটি সংশোধন করে ব্যয় না বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ায়।
এরপর বাজেটের আকার বাড়িয়ে ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা করা হয় এবং আরেক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
তবে, এখন প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক দফা বাড়ানোর আবেদন করবে কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পের পরিচালক একেএএম ফজলুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'পাশাপাশি প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ২ হাজার কোটি টাকা করার অনুরোধ জানানো হবে।'
কেন এত দেরি?
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বেশিরভাগ অংশ আর্থিক ও প্রকৃত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে সরকারের পক্ষ থেকে কাস্টমস শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়া এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছর এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির কারণে ১৭ মাস প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
এতে বলা হয়, জমি অধিগ্রহণে যে সময় নেওয়া হয়েছে তা প্রত্যাশিত ছিল না। এটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রংপুরের এম এ ওয়াজেদ মিয়া নলেজ পার্কের ভৌত অগ্রগতি ছিল ১৯ শতাংশ।
এছাড়া নাটোরে হাইটেক পার্কের ৩১ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৩২ শতাংশ, জামালপুরে ২৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, খুলনায় ২৫ দশমিক ১০ শতাংশ, বরিশালে ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ, গোপালগঞ্জে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ, ঢাকার কেরানীগঞ্জে ৩১ শতাংশ, কুমিল্লায় ২ দশমিক ১০ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১ শতাংশ, কক্সবাজারের রামুতে ১ শতাংশ এবং সিলেটের হাইটেক পার্কে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রামু ও সিলেটের পার্কের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালে।
একেএএম ফজলুল হক অবশ্য বলেন, আইএমইডির প্রতিবেদন পুরনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৩৩ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৯২ শতাংশে।
মাঠ পরিদর্শনেও কিছু ত্রুটি খুঁজে পাওয়া গেছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন কেরানীগঞ্জ নলেজ পার্কের নির্মাণ কাজে নিম্নমানের বালু ব্যবহার করা হয়েছে। বালির মধ্যে আবার বড় আকারের পাথর পাওয়া গেছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের নির্মাণ কাজে ইস্পাত শাটারিং ব্যবহার করার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল। কিন্তু সাইটে কাঠ পাওয়া গেছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের শেষ কোথায়
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি মঙ্গলবার বলেন, 'প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে জবাবদিহিতার অভাবে এ ধরনের বিলম্ব নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের সাত বছরে মাত্র ১৪ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃত অর্থনৈতিক আয় কীভাবে নিশ্চিত হবে- তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
'প্রকল্প বাস্তবায়নের এই বাজে সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশ কখনোই প্রত্যাশিত সুফল পাবে না। এ সংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া এই বিশাল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি জাতির জন্য কোনো ফল বয়ে আনবে না।'
'এতে জনগণের অর্থেরও অপচয় হবে,' বলেন তিনি।
মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যখন যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে ব্যর্থ হয়, তখন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
একেএএম ফজলুল হক জানান, ২০২০ সালের শেষের দিকে তিনি বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে বর্তমান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে তিনজন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক দরপত্র থেকে তেমন সাড়া মেলেনি। ফলে পুনরায় দরপত্র দেওয়া হয়েছিল এবং চার বছরে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
যেহেতু লাইন অব ক্রেডিটের শর্ত অনুযায়ী শুধুমাত্র ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিলামে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তাই মহামারির কারণে সম্ভাব্য দরদাতারা দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাংলাদেশ সফর করতে না পারায় প্রকল্পটি স্থবির হয়ে পড়ে।
২০২২ সালে প্রকল্পের অর্ধেক একজন দরদাতাকে এক প্রকার পুরষ্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। পরে ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল।
তিনি বলেন, '১ শতাংশ সুদে অর্থায়ন করা এই প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ উপকরণ ভারত থেকে আসার কথা এবং চুক্তি অনুযায়ী কাস্টমস শুল্ক সরকারের দেওয়ার কথা ছিল।'
'কিন্তু শুল্ক বাবদ আমরা অর্থ পাচ্ছি না, এটি ধীর অগ্রগতির একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
Comments