অপাঙ্‌ক্তেয়

রাহাত মিনহাজ

সর্বজনীন প্রত্যয়ের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে। এমন স্থবির, কোলাহলহীন ক্যাম্পাসে যেতে ইচ্ছে করে না। চারদিকে বেদনাদায়ক শূন্যতা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চত্বর সব সময় শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে, সেখানে এখন দীর্ঘ সময় অলস শুয়ে থাকে কয়েকটি কুকুর।

বুধবার বিভাগে গিয়েছিলাম। কুকুরগুলোর দেখা পেলাম। দু পাশে দুটো প্যান্ডেল। একটা শিক্ষকদের, অন্যটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। অনির্দিষ্টকালের আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনে কে কতটুকু অর্জন করবেন জানি না, তবে নিঃসন্দেহে বিসর্জনের বেদনা বইছেন শিক্ষার্থীরা। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি নিজে মাস শেষে ঠিকই বেতন পাব এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও ব্যাংক হিসাবে ঢুকবে ঠিকঠাক। কিন্তু অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ও প্রতিদিনের জীবনধারণের ব্যয় বহন করা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই ক্ষতির শিকার শিক্ষার্থীরা। এটা বড় ক্ষতি। এ অপূরণীয় ক্ষতি কীভাবে পূরণ হবে আমার ঠিক জানা নেই। নিজেকে ভীষণ অপরাধী, অপরাধী লাগে।

প্রত্যয়ের ব্যত্যয় নিয়ে কথা কম হয়নি। সবই ঠিক আছে, সরকার নতুন পেনশন পরিকল্পনা ঘোষণা করতেই পারে। সরকার দাবিও করতে পারে এই পরিকল্পনা আগের চেয়ে অনেক লাভজনক, আধুনিক সুবিধাসম্বলিত। এতেই শিক্ষকদের অধিকতর কল্যাণ! কিন্তু বাধ্য করতে হবে কেন? কোন যুক্তিতে? ঘোষিত পরিকল্পনা অধিক নিরাপদ ও লাভজনক হলে কাউকে তো বাধ্য করার দরকার ছিল না। নাকি এর পেছনে কোনো শুভঙ্করের ফাঁকি আছে? আছে কোনো মতলববাজী? যে কারণেই চাপিয়ে দেওয়া, বাধ্য করা! আমলাতন্ত্র, বিচারবিভাগ, সেনাবাহিনী বাদ দিয়ে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মীদের জন্য ১ জুলাই থেকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় চাপিয়ে দেওয়াকে তাই ভালো চোখে দেখার সুযোগ নেই।

গত ১ জুলাই থেকে কর্মবিরতি চলছে। অনেকে বলতে পারেন শিক্ষকরা ভালোই আছেন। কাজ করতে হচ্ছে না, মধ্যরাতে ইউরো দেখছেন, বেলা করে ঘুমোচ্ছেন। সব তো ঠিকই আছে, বেতন তো বন্ধ হয়নি। বিষয়টা এমন সরল নয়। বরং আমি বলব, ১ জুলাই থেকেই শিক্ষকরা ভয়ানক মানসিক পীড়নে আছেন। সরকারের তরফ থেকে নজিরবিহীন উপেক্ষায় শিক্ষকরা হতাশ। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, ক্লাস বাদ দিয়ে সামিয়ানা টাঙিয়ে দিনের পর দিন বসে থাকলেও সরকারের তরফ থেকে সংবেদনশীল কোনো উদ্যোগ নেই। বরং উপেক্ষা, অবহেলার দৃষ্টিভঙ্গি দৃশ্যমান। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, এই অবহেলা শিক্ষকদের কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে এতটা গুরুত্বহীন, এই বিষয়ে কারও কোনো ধারণা ছিল না।

সাহিত্য সম্ভারে 'অপাঙ্‌ক্তেয়' বলে একটা শব্দ আছে। যার অর্থ হচ্ছে পঙ্‌ক্তি বা কবিতার লাইনে স্থান পাওয়ার অযোগ্য। অপ্রয়োজনীয়, অতিরিক্ত ও উপযোগিতাহীন বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনে সরকারের মনোভাব দেখে এই শব্দটিই বারবার মনে পড়ছে। প্রশ্ন জাগছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কি রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে অপাঙ্‌ক্তেয়? এইতো গত মে মাসে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ হওয়ার পর এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সড়ক অবরোধ করেছিলেন রিকশাচালকরা, সংঘর্ষও হয়েছিল। সেই সময় অতি দ্রুত সরকারের শীর্ষ মহল থেকে নির্দেশনা এসেছিল। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ নয়, তাদের চলার রুট ঠিক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন সরকারপ্রধান। কিন্তু হায়! প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। অথচ যেন দুনিয়ার কোথাও কিছু ঘটছে না! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি এতটা অপাঙ্‌ক্তেয়, এতটা গুরুত্বহীন? নাকি শিক্ষকদেরও সড়ক অবরোধ করতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে?

আরেকটি বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন। বুদ্ধিজীবী বলতে সমাজের বড় একটা অংশের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বুঝে থাকেন। যদিও এ ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। প্রান্তিক অঞ্চলের একজন সামান্য স্কুল শিক্ষকও বুদ্ধিজীবী হতে পারেন। বুদ্ধিজীবী হতে পারেন একজন লেখক, লোককবি, বাউলশিল্পী, পরমতসহিষ্ণু এমনকি একজন ধর্মগুরু বা অন্য কোনো পেশাজীবী। বুদ্ধিজীবীর কাজ হলো—তিনি বুদ্ধি-বিবেচনা ও প্রজ্ঞা দিয়ে বর্তমান সংকটকে বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের দিশা দেবেন। বুদ্ধিজীবীর অবস্থান থাকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন সমাজের বিভিন্ন অন্যায়, অনাচার, কেলেঙ্কারি, লুণ্ঠন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সোচ্চার না হয়ে নিশ্চুপ থাকেন, তখন মানুষের কাছে নেতিবাচক একটি বার্তা যায়। এর বিপরীতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করাই ভালো। কারণ আমাদের সহকর্মী শিক্ষকরা কিছু ঘটনায় এমন সব শিরোনাম সম্বলিত ব্যানার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন, বক্তব্য রেখেছেন, শিক্ষক সমিতির প্যাডে বিবৃতি দিয়েছেন যাতে শিক্ষকদের নিরপেক্ষতা, প্রজ্ঞা ও বিবেচনাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। শিক্ষকরা হাসির পাত্র হয়েছেন। দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও আনুগত্যের প্রশ্নে শিক্ষকদের অনেকেই আখ্যায়িত করেছেন 'পোপের চেয়ের বড় ক্যাথলিক' হিসেবে।

কারণে-অকারণে এই অন্ধ আনুগত্য, স্তুতি-স্তাবকতা আর প্রতিবাদহীন থাকার কারণে শিক্ষকদের আজকের অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়ার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। আমার ধারণা, এর সংযোগ আছে। শতভাগ আছে। কিন্তু এই বোধ আসলেই হয়?

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia calls for unity

‘Seize the moment to anchor democracy’

Urging people to remain united, BNP Chairperson Khaleda Zia has said the country must quickly seize the opportunity to institutionalise the democratic system.

6h ago