রক্তাক্ত জুলাই থেকে কি কোনো শিক্ষা হবে?
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে একটি সপ্তাহ (১৬-২২ জুলাই) পুরো জাতি শ্বাসরুদ্ধকর সময় পার করল। দিন-ঘণ্টার সঙ্গে বাড়ছিল লাশের সংখ্যাও। সেই সঙ্গে সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও, ধ্বংসযজ্ঞ চলছিল নজিরবিহীন। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন, কারফিউ জারি করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। অনলাইন পত্রিকাগুলোতে আপডেট তথ্য না থাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ায় নানা ধরনের গুজব। ইন্টারনেট বন্ধ হলে পুরো সপ্তাহ জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে।
গত ২৩ জুলাই থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। স্বাধীনতার পর এ দেশে এমন পরিস্থিতি কখনো তৈরি হয়নি। অতি অল্প সময়ে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের খুন হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এর আগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সাড়ে নয় বছরে প্রায় আড়াইশ মানুষ গুম-খুন হয়েছিলেন। জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার বিদ্রোহে এক সপ্তাহে প্রায় সমপরিমাণ মানুষ গুম-খুন হয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন শুরু করলেও এটা আর তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কেন এই আন্দোলন হঠাৎ করে ব্যাপক আকার ধারণ করে? ১ জুলাই শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের এই সামাজিক আন্দোলন ছিল অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা অনেক দিন ধরেই চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি করে আসছিলেন কিন্তু সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। বরং একে নানাভাবে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী ও রাজাকার তকমা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য বক্তব্য, সরকারের গোঁয়ার্তুমি, ব্যর্থতা এবং ছাত্রলীগ-পুলিশের ভূমিকার কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। বিশেষ করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
সার্বিকভাবে গত দেড় দশকের শাসনকালে সরকার যে অনিয়ম, দুঃশাসন, দুর্নীতি ও জনজীবনে সংকট তৈরি করেছে, এই পরিস্থিতি ছিল সেই পুঞ্জিভূত ক্ষোভের তীব্র বহিঃপ্রকাশ। ক্ষমতাসীনরাও এই দেড় দশকে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের ঘটনাও তারা মোকাবিলা করেছেন কিন্তু কোনোটাই এতটা শ্বাসরুদ্ধকর ও বিপজ্জনক ছিল না।
এই আন্দোলন যে ক্ষমতাসীন দলকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল, মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অতীতের বিপদগুলোকে নিজ গণসংগঠন ও পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও এবার তাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই আন্দোলন বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ক্ষমতাসীনদের দল এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অক্ষম। পরিস্থিতি আরও ব্যাপক ও দীর্ঘ হলে হয়তো সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত।
বড় কোনো প্রতিরোধ ছাড়া সরকার ৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। এই ঘটনা সরকারকে অনেকটা নির্ভার করেছিল, আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল কিন্তু এই ঘটনা তাদের সেই দম্ভ চূর্ণ করেছে। যদিও পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সুর ও মনোভাব পাল্টে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেছেন, 'কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনের সময় সহিংসতার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী, জামায়াত-বিএনপি ও জঙ্গিদের আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের একের পর এক চিহ্নিত করব। তাদের আইনের মুখোমুখি করব। এখান থেকে আমরা এক পা সরে দাঁড়াব না।'
আওয়ামী লীগ আবারও যে ভুলটি করছে সেটি হলো, তারা এই সহিংসতাকে বিএনপি-জামায়াত কাণ্ড বলে প্রচার করছে ও নিজেরা বিশ্বাস করছে। তারা কোনোভাবেই বুঝতে চেষ্টা করছে না যে, ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম, পাচার, জনজীবনের সংকট মানুষকে বিদ্রোহী করে তুলেছে। গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে সমাজে তাদের অবস্থান একেবারে তলানিতে।
তৃতীয় পক্ষ এই আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে ব্যাপক সহিংসতা ঘটিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী কে? সে কথা কেন বলা হচ্ছে না? সরকার কেন একবারের জন্যও ভাবছে না যে, এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাই দায়ী!
সরকার এই ঘটনার জন্য শিক্ষার্থীদের দায়ী না করে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করছে। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, তৃতীয় কোনো শক্তির অনুপ্রবেশ ছাড়া এত অল্প সময়ে এমন প্রলয় ঘটানো সম্ভব না। এ জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনার দরকার। সেই অভিজ্ঞতা এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেই। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একটি নিরীহ ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক আন্দোলন। এই আন্দোলন যারা করেছেন, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী না—সাধারণ শিক্ষার্থী।
নরসিংদী কারাগারে আক্রমণে করে কয়েদিদের মুক্ত ও অস্ত্র-গুলি লুট করা হয়। এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, প্রশিক্ষিত কোনো বাহিনী ছাড়া এমন কাজ সম্ভব না। শত শত গাড়ি, ভবন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও মেট্রোরেলে হামলা, গান পাউডারের ব্যবহার খেয়ালের বশে হঠাৎ হওয়ার কথা না। টিভি ভবনে হামলা ও এর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টাও কোনো সাধারণ ঘটনা নয়—পূর্ব পরিকল্পনার অংশ।
এ প্রসঙ্গে কোটা আন্দোলনকারীদের বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ। ২৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ বলেন, 'পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন ধরনের নাশকতা করে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় ও জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি করে। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এসব সহিংস ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।'
সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও দমন-পীড়ন নীতির জন্য অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত, হেফাজতের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন এবং একে একদফার আন্দোলনে পরিণত করতে তাদের নেতাকর্মীদের সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি নেতা তারেক রহমানও ভিডিও কনফারেন্সে অভিন্ন বার্তা দিয়েছেন।
তাহলে সরকার যে অভিযোগ করছে তা ভিত্তিহীন নয়। তবে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, জনমনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভে বারুদে আগুনের ফুলকি পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে এবং মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছাড়িয়েছে।
শিক্ষার্থীরা সরকার পতন চাননি। এমনকি তারা যে চার বা আট দফার কথা বলেছেন, সেখানেও এমন বক্তব্য নেই। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সর্বস্তরের মানুষ সমর্থন করেছে। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেকে এবং খোদ বীর মুক্তিযোদ্ধারাও কোটা সংস্কারকে সমর্থন করেছেন।
সরকারবিরোধীরা বৈরী পরিস্থিতির সুযোগ নেবে এটা সাধারণ ঘটনা। কেবল বিরোধীরাই নয়, ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরেও নানা সংস্থা-প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিও সুযোগ নিতে চায়! এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী বেশ কয়েকবার ক্ষমতা দখল করেছে।
বিএনপি ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়া জনজীবনের কোনো সংকট নিয়ে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু দেশে যখনই জনস্বার্থকেন্দ্রীক কোনো আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছে এবং সেই আন্দোলন তখন সরকারবিরোধী তকমা পেয়েছে। এবারও বিরোধীদের ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে শাসকরা এক ধরনের বৈধতা নেওয়ার চেষ্টা করেছে।
একটি বিষয় পরিষ্কার যে, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে নিরীহ চেহারায় রাখা যায়নি। সে ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা ও বেপরোয়া আচরণ দায়ী। সরকার যতটুকু নমনীয় হয়েছে, সেটি বাস্তবতার চাপে, বাধ্য হয়ে। ছাত্রদের এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে কাঠামোগত সংগ্রাম ছিল না। এটি ছিল এক বিশেষ পরিস্থিতিতে জন আকাঙ্ক্ষার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। তাকে মোকাবিলা করা উচিত ছিল সেই বিবেচনা ও কৌশলেই। সরকার সেখানেও ব্যর্থ হয়েছে। প্রচলিত ধারার পুলিশি অ্যাকশন ও দলীয় ক্যাডার নির্ভরতা এখানে কোনো কাজে আসেনি, বরং হিতে বিপরীত হয়েছে।
যাই হোক, সরকার যেহেতু কিছুটা নমনীয় হয়েছে, শিক্ষার্থীদের উচিত আলোচনার মাধ্যমে বাকি দাবিগুলোর সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতিতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় আসা। তবে কোনো চাপ বা মোহে রাজনৈতিক ফাঁদে পা দেওয়া কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এই আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের যে সমর্থন আছে, সেটি বজায় রেখে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অর্জন নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়াই হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় বিজয়।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Comments