‘শর্তসাপেক্ষে ছেলের লাশ দিয়েছিল, লাশের গাড়িটাও মিরপুরে নিতে দিতে চায়নি’
সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা এবং শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে আরও অনেকের মতো গত ১৯ জুলাই মিরপুরের রাস্তায় নেমে এসেছিলেন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান।
সেদিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু করে।
একটা গুলি এসে লাগে মাহফুজুরের মাথায়। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেখানেই মৃত্যু হয় ১৫ বছরের এই কিশোরের।
'আমার ছেলেটা যে কত ভালো ছিল সেটা তার মৃত্যুর পর বুঝতে পারছি', চোখের পানিতে বলছিলেন ছেলে হারানো বাবা আব্দুল মান্নান।
পেশায় রিকশা ভ্যানচালক মান্নান সবসময় ভয় পেতেন, ছেলে যাদের সঙ্গে মিশছে হয়তো বিপথে চলে যেতে পারে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন সবসময়। কিন্তু সেই আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে চলে গেছে সে।
'আমার ছেলেটা স্বৈরাচার সরকারের কবল থেইকা দেশের মানুষরে মুক্ত করতে নিজের জীবন দিয়া চইলা গেছে। আমার ছেলেটারে যেভাবে মারছে আমি তার বিচার চাই,' বলছিলেন মান্নান।
মিরপুর-১১ নম্বরের মদিনা নগরে মাহফুজদের ছোট্ট ভাড়া বাসায় কথা হয় পরিবারটির সঙ্গে।
ছেলের জন্য চিৎকার করে কাঁদছিলেন মা মুসাম্মদ বেগম। এখনো বিশ্বাস হয় না তার ছেলেটা নেই।
সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনা যখন বলছিলেন মান্নান, অর্ধেকটা শুনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মা মুসাম্মদ বেগম। জ্ঞান ফিরে আসার পরও মানতে পারছিলেন না ছেলে আর নেই।
'আমার কলিজাটা ছিঁড়া গেছে। আমার ছেলেটা আর মা বলে আমারে ডাকবো না।'
মান্নান আর মুসাম্মাদ দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তিন মেয়ের পর আসে মাহফুজ। সবার ছোট, তাই বোনদেরও আদরের চোখের মণি মাহফুজ।
মাহফুজকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন। আশা ছিল বড় হয়ে একদিন দরিদ্র এই পরিবারটির হাল ধরবে ছেলে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে, বাবা মায়ের দুঃখ ঘুচবে। তবে সেই স্বপ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতেই শেষ হয়ে গেছে।
'বাইরের পরিস্থিতি দেখে আমি তাকে ঘরের বাইরে যেতে দেই নাই। মানা করছি। কিন্তু সে আমারে ধোঁকা দিয়ে বাইরে চলে গেছে। বলে, মা আমি জুমার নামাজ পইড়া আইসাই তোমার সাথে দুপুরের খাবার খাবো। আমারে বলে, মা তুমি কিন্তু খাবার রেডি কইরা রাখবা। আইসাই খাবো,' বলছিলেন মাহফুজের মা।
নামাজের পরও যখন মাহফুজ ফেরে না, তখন তার স্বামী মান্নান, মেয়েজামাই ও মাহফুজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে মিরপুর-১০ নম্বরে খুঁজতে বের হন। তখনই একজন শিক্ষার্থীর কাছে জানতে পারেন বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের লোকজন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নির্বাচারে গুলি চালিয়েছে, একটা গুলি মাহফুজের লেগেছে।
উদভ্রান্তের মতো সেদিন সারারাত আর পরদিন বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলের খোঁজ করেন মান্নান ও স্বজনেরা।
২০ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জানতে পারেন তার আদরের ছেলে আর নেই।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গের একজন সহকারী মান্নানের মোবাইল ফোনে একটি ছবি দেখে মাহফুজুরকে শনাক্ত করেন। জানান যে তার ছেলের লাশ মর্গে আছে।
মান্নান ছেলের লাশ ফেরত চেয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় যান। পুলিশ এই শর্তে লাশ দেবে বলে জানায় যে লাশ দাফনের জন্য সরাসরি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে তাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যেতে হবে, অন্যকোথাও নেওয়া যাবে না।
তবে হাসপাতালে জড়ো হওয়া মিরপুরের শিক্ষার্থীরা জানাজার নামাজের জন্য মাহফুজুরের মরদেহ বহনকারী গাড়িটি মিরপুরে নিয়ে যায়।
কিন্তু সেখানে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সদস্যরা গাড়িটিকে মদিনা নগরে ঢুকতে বাধা দেয়। লাশের জানাজার জন্য শিক্ষার্থীরা এরপর মাহফুজের স্কুল মাঠে নিয়ে অনেক অনুরোধের পর অল্প সময়ের জন্য জানাজার সুযোগ পায়।
চোখের পানিতে তড়িঘড়ি করে বিদায় জানায় তাদের প্রিয় সহপাঠীকে। মধ্যরাতে গ্রামের বাড়িতে দাফন হয় মাহফুজুরের।
'আমি যখন আমার ছেলের জানাজায় অংশ নিচ্ছিলাম, তখন আমি বেশ কয়েকটি ফোন পাই, আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে এই আশঙ্কায় অনেকে আমাকে পালায় যেতে অনুরোধ করেন। কারণ পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা করছে বলে জানান তারা,' বলেন মান্নান।
ছেলের মৃত্যুর পর, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমার বাড়িওয়ালাকে আমরা 'রাজাকার' এই কথা বলে আমাদের বের করে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়, বলেন মান্নান।
নিরাপত্তার ভয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মান্নান আর ঢাকায় ফেরেননি।
'মাহফুজের ন্যায়বিচার বোধ অনেক বেশি ছিল। ও সব সময় ন্যায়ের পথে থাকতে চেয়েছে,' বন্ধুকে মনে করে কথাগুলো বলছিল সহপাঠী আতিক রহমান।
আতিক বলেন, 'মাহফুজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। আমরা চাই ওর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে আমাদের এলাকায় ওর সম্মানে একটি খেলার মাঠের নামকরণ করা হোক।'
Comments