জনগণের ভাষা বুঝতে পারছে না আওয়ামী লীগ

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

টেবিলে বসে যে বিষয়ের আলোচনা করা যেত, সমাধান দেওয়া যেত, সেই বিষয়টিকে রাজপথে নিয়ে যাওয়া হলো, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল অসংখ্য শিক্ষার্থী, শিশু, বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন। অতঃপর এলো সেই দাবির আংশিক বাস্তবায়ন। কিন্তু গোটা জাতি তখন শোকে বিহ্বল। একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে কোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এমন মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার তাদের জীবন দিয়ে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়েছিল সেই দাবি মানতে। আজকের শাসকগোষ্ঠীও দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। পার্থক্যটা রইল কোথায়? বাবার কোলের সন্তান থেকে রিকশাচালক, শ্রমিক, দিনমজুর, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সাংবাদিক—কে নেই এই মিছিলে? ইতিহাস কি ক্ষমা করবে এই কালোদিনকে। যে শিক্ষার্থীরা পাঠে থাকার কথা। তারা যখন মাঠে আসল তখনও তাদের দাবিকে অগ্রাহ্য করা হলো। তাদের মনোবেদনাকে একটুও বোঝার চেষ্টা করা হলো না। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার বদলে- পুলিশ, ছাত্রলীগকে দায়িত্ব দেওয়া হলো শিক্ষার্থীদেরকে দমানোর জন্য।

ছাত্র জনতার পাশে নারী সমাজ-ব্যানারে রাজধানীর পল্টনে বিক্ষোভ মিছিল হয়। ছবি: পলাশ খান

মুসলিম লীগ—যারা কিনা ছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মূল উত্তরসূরি, যারা পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যদিয়ে ভারতের মুসলিমদের একাংশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিল। সেই মুসলিম লীগ যখন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে গণ মানুষের ভাষা বুঝতে চায়নি কিংবা পারেনি সেই প্রেক্ষাপটেই মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগের উত্থান। আওয়ামী লীগ তখন গণমানুষের মনের দাবি বুঝতে পেরেছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণমানুষের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হতে পেরেছিলেন। আজকের এই সঙ্কট-সন্ধিক্ষণে এসে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ আর জনগণের ভাষা বুঝতে চাচ্ছে না, কিংবা পারছে না। সে কারণে তারাও সাম্প্রতিক সময়ের সকল সঙ্কটকে বিশেষ করে 'গণ' ও 'জন' দাবিকে 'বুলেট' দিয়ে মোকাবিলা করছে কিংবা 'বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র', এমন তত্ত্ব দিয়ে ধামা-চাপার চেষ্টা করছে। কখনো নিজ ছাত্রসংগঠন, যুব সংগঠনকে দায়িত্ব দিচ্ছে মানুষের কণ্ঠরোধ করার জন্য। এতে দিন দিন দলটি জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হচ্ছে।

দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার লোপাট হচ্ছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন তার নিজের পিয়ন পর্যন্ত চারশ কোটি টাকা লোপাট করেছেন। সাবেক পুলিশ প্রধান, সেনাপ্রধানের দুর্নীতির খবরে যখন গোটা দেশ হতবাক, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস, সেই মুহূর্তে দেশের প্রধান শত্রু হিসেবে শনাক্ত করা হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। যারা বৈষম্যহীন সমাজ চায়, যেটা কিনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, সেই দাবি নিয়ে যারা রাজপথে নামল তাদেরকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলি বিঁধল আমাদেরই সন্তানদের গায়ে। গোটা দেশ দেখল নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের সামনে বন্দুক নিয়ে দাঁড়ানো হলো। তিলে তিলে বাবা-মায়ের বড় করা সন্তান নিমিষেই নাই হয়ে গেল। এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। একটা পর্যায়ে এসে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের আংশিক দাবি মেনে নেওয়া হলো। মেনেই যদি নেবেন, তাহলে লাশের মিছিল কেন এত দীর্ঘ হলো? কেন আগেই আলোচনার টেবিল উন্মুক্ত হলো না?

যারা ক্ষমতার সঙ্গে থেকে সুবিধা ভোগ করছেন, দৃশ্যমান সঙ্কটকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন, তারা এর দায়ভার কীভাবে এড়াবেন?

একজন প্রত্ন-ইতিহাসের গবেষক হিসেবে অতীত থেকে যে বিষয়টি দেখতে পাই, যখন কোনো শাসকগোষ্ঠী জনগণের মনের ভাষা বুঝতে পারে না, নিজের বোঝাপড়াকে সবার ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, ইতিহাসে তারা জননন্দিত হতে পারে না। বিরোধীদল কিংবা ষড়যন্ত্রের বুলি আওড়ানোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের উচিত হবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গনে মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করা। চোখ রাঙানি, বুলেট দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় না। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের ভাষাও এমন হতে পারে না। বরং যুগে যুগে স্বৈরাচারী শাসকেরা এসব উপকরণ গণমানুষের কণ্ঠরোধে ব্যবহার করে থাকেন।

মুতাসিম বিল্লাহ: শিক্ষক-প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল: [email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

2h ago