ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ: ২০ জুলাই মধ্যরাতে নাহিদকে তুলে নিয়েছিল কারা

সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না সমন্বয়করা
নাহিদ ইসলাম। ছবি: স্টার

কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলামকে গত ২০ জুলাই মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়, যদিও বিষয়টি তারা অস্বীকার করেছে।

দ্য ডেইলি স্টার কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, মধ্যরাতে রাজধানীর সবুজবাগে, যেখান থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়েছিল সেসময় ওই বাসার কাছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৩ এর একটি গাড়ি, একটি এসইউভি, একটি মাইক্রোবাস ও দুটি মোটরসাইকেলের উপস্থিতি ছিল।

তুলে নেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর পূর্বাচলে জ্ঞান ফেরে নাহিদের। সারা শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।

গত ২৬ জুলাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে আবার তুলে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। নাহিদসহ ছয় সমন্বয়ককে 'নিরাপত্তার জন্য' হেফাজতে নেওয়ার কথা জানিয়েছে ডিবি।

ডিবি হেফাজতে নেওয়ার আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ২০ জুলাই ২৫-৩০ জন সাদা পোশাকের ব্যক্তি রাত ২টার পরে তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়েছিল। তারা গেট ভেঙে বাসায় ঢোকে।

গাড়িতে তোলার পর নাহিদের চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। গাড়িটা প্রায় ৩০-৪০ মিনিট চলে। পরে তাকে একটি রুমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও মারধর করা হয়। মারধরের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

জ্ঞান ফেরার পর একটি ওভারব্রিজের নিচে নিজেকে আবিষ্কার করেন নাহিদ। সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারেন সেটি পূর্বাচল এলাকা। সেখান থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

নাহিদ জানান, রাত ২টার পরে তাকে গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে ফেলার আগে তিনি একটি র‌্যাবের গাড়িও দেখতে পেয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরাও একই বর্ণনা দিয়েছেন। নাহিদ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজের মিল পাওয়া গেছে।

ভিডিওতে যা আছে

সবুজবাগে যে বাসা থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ওই ভবনের কাছাকাছি বিভিন্ন সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছে ডেইলি স্টার।

সেসব ভিডিও নিশ্চিত করে যে, ২০ জুলাই রাত ১টা ৫১ মিনিট থেকে ২টা ১২ মিনিটের মধ্যে অন্তত একটি র‌্যাব-৩ এর ভ্যান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল।

রাত ১টা ৫১ মিনিটের দিকে সবুজবাগের নন্দীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে দুটি মোটরসাইকেল, একটি এসইউভি, একটি মাইক্রোবাস ও একটি র‌্যাবের ভ্যান থামে।

নাহিদের বন্ধুর বাসা, যেখানে তিনি রাতে অবস্থান করছিলেন সেখান থেকে গাড়িগুলোর দুরত্ব মাত্র দেড়শ মিটার।

গাড়িগুলো নন্দীপাড়া মোড়ের দিক থেকে এসে প্রায় ২০ মিনিট সেখানে অবস্থান করে। পরে একই দিকে ফিরে যায়।

এই সময়েই নাহিদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও নাহিদ নিজে জানিয়েছেন।

২০ জুলাই রাত থেকেই দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। ওই এলাকার রাস্তায় তখন শুধু অ্যাম্বুলেন্স ও কয়েকটি ট্রাকের চলাচল ছিল। এর মধ্যেই রাতে র‌্যাব-৩ এর ভ্যানসহ অন্য গাড়িগুলো সেখানে থামে।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে যে দুটি মোটরসাইকেলে পিলিয়ন ছিল এবং গাড়ি দুটির বেশিরভাগ সিটেই কেউ না কেউ বসে ছিল।

প্রথমে মাইক্রোবাসটি বাসার কাছাকাছি যায়। এসইউভি ও র‍্যাব-৩ এর ভ্যানটি সেখানে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে। সেসময় এসইউভির পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে চার-পাঁচজনকে ফোনে কথা বলতে দেখা গেছে।

এসইউভির পেছনের দরজা বা বোনেট দুবার খোলা হয়, রাত ১টা ৫৪ মিনিট এবং রাত ২টায়।

প্রথমবার পেছনের দরজা খুলে একজন ব্যক্তি একটি হেলমেট রাখেন। পরেরবার আরেকজন গাড়ির পেছনের দরজা খুলে একটি বড় কাটারসহ কিছু সরঞ্জাম নেন।

রাত ২টা ২ মিনিটে এসইউভি গাড়িটি নাহিদ যে ভবনে ছিল সেদিকে চলে যায়। র‌্যাবের ভ্যানটিও সেদিকে ফলো করে।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, নাহিদকে আটক করতে সাদা পোশাকের কয়েকজন ভবনের গেটের তালা ভেঙে ফেলে।

পাশের একটি ভবনের একজন নিরাপত্তারক্ষী জানান, মোট ২৫-৩০ জন সাদা পোশাকের ব্যক্তি সেখানে ছিল। তাদের মধ্যে চার-পাঁচজন সীমানা প্রাচীরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে মূল ফটকের ভেতরে ঢুকে।

'প্রথমে তারা লোহার রড দিয়ে মূল গেটের তালা ভাঙে। তারপর একটি গাড়ি থেকে কাটার নিয়ে এসে ভেতরের কলাপসিবল গেটের আরও দুটি তালা কেটে বাড়িতে প্রবেশ করে,' বলেন তিনি।

সিসিটিভি ফুটেজে তিনটি গাড়ি এবং দুটি মোটরসাইকেলকে রাত ২টা ১২ মিনিটে ওই এলাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। পুরো সময় জুড়ে চালকসহ আটজন ইউনিফর্ম পরা র‌্যাব কর্মকর্তার কাউকে গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায়নি।

শুধু সাদা পোশাকের লোকজন, যারা র‌্যাবের পাশাপাশি অন্যান্য গাড়িতে এসেছিল তারাই গাড়ি থেকে নামেন।

ডেইলি স্টার একটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর 'ঢাকা মেট্রো ঘ ১৪৪৩৮৫' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ থেকে ওই নিবন্ধন নম্বর যাচাই করা যায়নি। কারণ গতকাল রাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের সার্ভার বন্ধ ছিল।

কয়েকবার চেষ্টা করেও র‌্যাব-৩ এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী যোবায়ের আলম শোভনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি ডেইলি স্টার। একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস জানান, ২০ জুলাই নাহিদকে তুলে নেওয়ার সঙ্গে র‌্যাবের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

তিনি বলেন, 'তখন ছিল কারফিউয়ের প্রথম রাত। সারা দেশে আমাদের ৩০০টিরও বেশি গাড়ি টহলরত ছিল।... আপনারা হয়তো ওই এলাকায় টহলরত কোনো গড়ি বা অন্য কোনো কাজে যাওয়া গাড়ি দেখতে পারেন।'

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক জানান, আইন ও সংবিধান অনুযায়ী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করতে হবে।

'নাহিদকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়নি। এটি বেআইনি ও আইন বহির্ভূত। এ ঘটনায় অপহরণ মামলা করা যেতে পারে। কিন্তু যেহেতু দেশে কোনো জবাবদিহিতা নেই, তাই কোনো থানা বা ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে হয়তো এমন মামলা গ্রহণ করবে না,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

CA’s special aide questions IMF, World Bank role in 15 years of graft

Global lenders extended loans without questioning the environment before the July revolution, he says

1h ago