ভিন্নমত ও সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ণের ভয়াবহতা

ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

'আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ

স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি'

উপরে উল্লেখিত পঙ্‌ক্তি দুটি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা 'আঠারো বছর বয়স' কবিতার। কেবল কিশোর ও তরুণরাই স্পর্ধায় মাথা তোলার ঝুঁকি নিতে পারে। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ সেই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তিনি ভিন্নমত প্রকাশের মাধ্যমে ন্যায্যদাবি প্রতিষ্ঠার প্রতীক হয়ে থাকবেন।

আবু সাঈদ মৃত্যুর আগের রাতে লেখা তার ফেসবুক পোস্টে একজন তরুণ শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করেছেন, যিনি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে থেকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের কিশোর শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগের রাতে তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, 'এমন জীবন গড়ো যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে।'

দুইজনই ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পরদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। উভয়ের মনের অবচেতন স্তরে নিশ্চয় একটি সত্য উঁকি দিয়েছিল—যে দেশে তারা জন্মেছেন, সে দেশের গণতন্ত্র সুসংহত নয়। নইলে একেবারে নিরস্ত্র ও পুলিশের জন্য হুমকিহীন অবস্থায় থেকে আবু সাঈদকে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করতে হতো না।

ভিন্নমত প্রকাশ ও সমাবেশ করার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। ছাত্ররা সেটাই করছিলেন। সামান্য অতীতচারী হলে দেখা যাবে প্রবল ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সিস্টেম বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল থাকে। এরপর ১ জুলাই থেকে শুরু হয় ছাত্রদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলন।

সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের জন্য ছিল মাত্র ৪৪ শতাংশ আসন। বাকি ৫৬ শতাংশ কোটার দখলে। চাকরিপ্রার্থীদের জন্য নিশ্চিতভাবেই বিষয়টি উদ্বেগের। শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সরকারি চাকরির সব পদে কোটা সংস্কারের দাবি জানায়। এই আন্দোলন ১ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত অহিংসই চলেছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ছাত্রদের আন্দোলন ঘিরে নানা মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, ছাত্ররা 'লিমিট ক্রস' করছে, 'সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছে', 'রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না'। এমনকি গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।' মূলত সরকার কোর্টের এখতিয়ার বলে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। যদিও এটি কোর্টের বিষয় নয়, কৌশলে কোর্ট পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। এটি আসলে নির্বাহী আদেশের বিষয়।

১৪ জুলাই সরকারপ্রধানের একটি কথার সূত্র ধরে আন্দোলনকারীরা এমন একটি শব্দ ব্যবহার করে—যেটিকে অন্য পক্ষ আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার অস্ত্র হিসেবে লুফে নেন। ছাত্রদের ব্যবহৃত ওই শব্দটি ছিল আয়রনি—যা তারা না বুঝেই করেছেন। তাদেরকে নিষেধ করা যেত যে, এই ধরনের অশোভন শব্দ তোমরা ব্যবহার করো না। এমন কোনো উদ্যোগ দায়িত্বশীল কোণ থেকে নেওয়া হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ১৫ জুলাই ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুপুর দুইটায় 'রাজাকার' স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন। ওই দিন বিকেল তিনটা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ছাত্রলীগের কাজ কি ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা? আমার জানামতে, কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের ব্রত হচ্ছে: প্রথমত, লেখাপড়া করা। দ্বিতীয়ত, নানা ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করা। অথচ দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে বিপরীতমুখী নির্দেশনা এলো ছাত্রলীগের কাছে। এমনিতেই তারা 'নাচুনে বুড়ি' তার ওপর পড়ল 'ঢোলের বাড়ি'। ১৫ জুলাই থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সহিংসতার পথে নেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ৩৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকার শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে পালন করছিলেন। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায়ও অনুরূপ অধিকারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

১৬ জুলাই সারাদেশে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। ওইদিন সারাদেশে ছয়জন নিহত হন। ১৭ জুলাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৮ জুলাই খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে দলে দলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যোগ দেয় কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করেও শিক্ষার্থীদের সমবেত হওয়ার এই বিস্ফোরণ রুখে দেওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ন্যক্কারজনক হামলা চালায় ছাত্রলীগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও হেলমেটবাহিনী। ওই দিন নিহত হন ২৭ জন। এদিন ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়।

১৯ জুলাই আন্দোলনকারীরা 'সর্বাত্মক অবরোধ' ঘোষণা করলে রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে ৫৬ জন নিহত হন। সরকার রাতে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।

২০ জুলাই আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আট দফা দাবি পেশ করেন। ২১ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত রায় প্রদান করেন। রায়ে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ শতাংশ এবং অন্যান্য দুই শতাংশ কোটা থাকবে। ২৩ জুলাই সরকার কোটা প্রথা সংস্কার করে গেজেট প্রকাশ করে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী ইতোমধ্যে নানা শ্রেণি, পেশা ও বয়সের দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।  স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো আন্দোলনে এত রক্তপাত ঘটেনি।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শিক্ষা, অর্থনীতি ও বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ে। অথচ ১৪ জুলাই ছাত্ররা মহামান্য প্রেসিডেন্টকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। সেই সময়ই ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসা যেত। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দূরদর্শী হলে তাই করতেন। শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা, অন্যায্য আস্ফালন আর অযৌক্তিক একগুঁয়েমির কারণে একটি সহজ বিষয় মারাত্মক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে!

লেখাটি শুরু করেছিলাম যেভাবে: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হয়েছেন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিতে। আর আবু সাঈদ শহীদ হয়েছেন তার স্বদেশের পুলিশের গুলিতে। গুলি ছোড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে পুলিশ কেবল কোমরের নিচে গুলি করতে পারে। অথচ ১৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৫ জন ছাত্র নিহত হয়েছেন। ছাত্রদের বুকে গুলি করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিখেছিলেন, 'জনাব নুরুল আমিন কত বড় অপরিণামদর্শী কাজ করলেন। গুলি ছুড়লেন তাও ছাত্রদের ওপর। মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল করতে থাকে'।

এখনো ছাত্র-সমন্বয়কদের সঙ্গে চলছে নাটকের মহড়া। তাদের হেফাজতের নামে ডিবি অফিসে তুলে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে তারা আন্দোলন তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। সাধারণ ছাত্রদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।  তাদের দোষ এটুকুই যে, তারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ভিন্নমত প্রকাশ এবং সমাবেশ করেছেন।

বর্তমান শাসকগোষ্ঠী নিজেদেরকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে দাবি করেন। আপনারা ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে নিজেদের আয়নায় একবার নিজেদেরকে দেখুন। এমন ভাবা ঠিক হবে না যে, আপনারাই শ্রেষ্ঠ এবং আপনাদের কথাই শেষ কথা। আপনারা শাসক, রাষ্ট্রের মালিক নন। নেতৃত্বের গুণাবলী লালন ও অনুশীলন করাটা আপনাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

ডক্টর সৈয়দা আইরিন জামান: পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও কলামিস্ট

Comments

The Daily Star  | English
tax collection target for IMF loan

IMF to continue talks with Bangladesh for near-term agreement

The global lender said such an agreement would pave the way for completing the combined third and fourth reviews

2h ago