‘মা যেতে দাও শহীদ হলে গর্ব করে বইলো আমার ছেলে শহীদ হইছে’

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ আহম্মেদ সিয়াম (বামে), এখনো গুছিয়ে রাখা সিয়ামের পড়ার টেবিল (ডানে)। ছবি: স্টার

গত ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে সাভারের থানা স্ট্যান্ড এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ আহম্মেদ সিয়াম। এনাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৭ আগস্ট মারা যান তিনি।

বুধবার দুপুরে সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবির ছেলে হত্যার অভিযোগে সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নয়জনের নাম উল্লেখ করে ঢাকা কোর্টে মামলা করেছেন।

গত ৫ আগস্ট সকালে শেষবারের মতো মায়ের সঙ্গে কথা হয় সিয়ামের। সকাল ১০টা থেকেই সরকার পতনের এক দফা দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জনতার সঙ্গে 'লং মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল সে। দু'হাত দিয়ে ছেলের পথ আটকে দেন মা, কিছুতেই তাকে বাসা থেকে বের হতে দেবেন না তিনি।

শুরুতে নানা অজুহাতে মাকে রাজি করাতে চাইল সিয়াম। এক পর্যায়ে হাসিমুখে বলল, 'মা যেতে দাও শহীদ হলে গর্ব করে বইলো আমার ছেলে শহীদ হইছে।'

এটাই ছিল মায়ের সঙ্গে সিয়ামের শেষ কথা।

সাভার ডেইরি ফার্ম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আলিফ আহম্মেদ সিয়াম।

আজ সন্ধ্যায় সরেজমিনে সিয়ামদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার পড়ার টেবিলে বই সাজিয়ে রাখা। তার কালো রংয়ের স্কুল ব্যাগটিও সেখানে ছিল। পাশেই সোফায় বসে কান্নায় মূর্ছা যাচ্ছেন সিয়ামের মা, স্কুল শিক্ষক তানিয়া আক্তার ও বাবা বুলবুল কবির।

সিয়ামের পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখা বই, অ্যাওয়ার্ড ও কালো রংয়ের স্কুল ব্যাগের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি বাবা বুলবুল কবির। ছবি:আকলাকুর রহমান আকাশ/ স্টার

তানিয়া আক্তার ও বুলবুল কবির দম্পতির এক মাত্র ছেলে ছিল সিয়াম। সিয়ামের ১১ বছর বয়সী একটি বোন রয়েছে।

সিয়ামের বাবা বুলবুল কবিরের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেইটে একটি কাপড়ের দোকান রয়েছে।

কান্নাজড়িত কন্ঠে বুলবুল কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবিটি যৌক্তিক ছিল৷ শুরু থেকে আমিও আন্দোলনে যেতাম যেন শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ হয়। আমার ছেলেও আমার সাথে আন্দোলনে যেত। গত ৫ আগস্ট আমি যাইনি। সেদিন ওকেও (সিয়ামকে) ওর মা যেতে দিচ্ছিল না। কিন্তু সিয়ামের তিন বন্ধু বাসার সামনে অপেক্ষা করছিল। শুরুতে সিয়াম তার মাকে বিভিন্ন কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। মা বারণ করলে একপর্যায়ে হেসে হেসে সে মাকে বলে, "মা যেতে দাও শহীদ হলে গর্ব করে বইলো আমার ছেলে শহীদ হইছে"। এই কথা বললে ওকে আর ওর মা আটকাতে পারেনি। পরে আমিও ওকে একটা মোবাইল দিয়ে দেই। ও বন্ধুদের সাথে জাহাঙ্গীরনগর ডেইরি গেইটে যায়।'

সেদিন দুপুর ১১টার দিকে সেখান থেকে ছাত্র-জনতার সাথে 'লং মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচিতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় সিয়ামও। পরে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলির মুখে পেছনে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

দুপুর ২টার দিকে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে বিজয় মিছিল নিয়ে আবারও ঢাকার অভিমুখে রওনা হয় সিয়াম। মিছিলটি আড়াইটার দিকে সাভার থানা স্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। সেখানে সিয়াম মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়।

সিয়াম অত্যন্ত মেধাবী ছিল উল্লেখ করে বাবা বুলবুল কবির বলেন, 'আমার বাবার পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল। এজন্য সে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। লেখাপড়া নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকত। অন্যায় কাজকে কখনোই সাপোর্ট করত না। খেলাধুলায়ও বাবা চ্যাম্পিয়ন ছিল। স্কুল পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার জিতেছে। আমার বাবার (সিয়াম) স্বপ্নের সাথে সাথে আমাদের স্বপ্নগুলো শেষ হয়ে গেল,' বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

সিয়ামের মা তানিয়া আক্তার বলেন, 'আমার কলিজার টুকরাকে হত্যার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিচার চাই। দেশবাসীর কাছে আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। আপনারা আমার ছেলের বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া করবেন মহান আল্লাহ যেন ওকে বেহেশত নসিব করেন।'

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আরিফ আহমেদ সিয়াম নিহতের ঘটনায় মামলার তথ্য নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক আতাউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা অভিযোগটি নথিভুক্ত করেছি এবং এর ফলে মামলার তদন্ত শুরু হলো।'

'তদন্ত শেষ হওয়ার পর আমরা পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর অফিসে প্রতিবেদন জমা দেব,' যোগ করেন তিনি।

এ মামলায় অন্য অভিযুক্তরা হলেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ। 

উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত গত ৫ আগস্ট সংঘর্ষের ঘটনায় সাভারে ৩৬ জন নিহতের তথ্য পেয়েছে দ্য ডেইলি স্টার।
 

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

2h ago