কোলন ক্যানসারের লক্ষণ, কাদের ঝুঁকি বেশি
কোলন বা বৃহদন্ত্রের ক্যানসারে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন এখন। এ সম্পর্কে জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কমিউনিটি বেজড ক্যান্সার হাসপাতালের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ও বাংলাদেশ ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
কোলন ক্যানসার কী
ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, মানবদেহে পরিপাকতন্ত্রের শেষ অংশের নাম কোলন বা বৃহদন্ত্র। এখানে শুরু হওয়া ক্যানসারকেই কোলন বা বৃহদন্ত্রের ক্যানসার বলে। পাকস্থলীর পর অপেক্ষাকৃত সরু ক্ষুদ্রান্ত্রের শুরু। আর ক্ষুদ্রান্ত্রের পরেই রয়েছে বৃহদন্ত্র।
বৃহদন্ত্রের কয়েকটি অংশ রয়েছে। যেমন- উর্ধ্বমুখী, অনুপ্রস্থ, নিম্নমুখী ও সিগময়েড কোলন। বৃহদন্ত্রের পরের অংশ রেকটাম বা মলাশয়। বৃহদন্ত্র ও মলাশয় এই দুই অংশের ক্যানসারকে একত্রে কোলোরেক্টাল ক্যানসার বলে। শরীরের অন্যান্য স্থানের মতো বৃহদন্ত্রে অক্ষতিকারক টিউমার হতে পারে, যা অন্য কোথাও ছড়ায় না। যেখানে উৎপত্তি টিউমার বড় হলেও সেখানেই থাকে, এগুলো ক্যানসার নয়।
বৃহদন্ত্রের ভেতরের দিকের আবরণী কোষের অতিরিক্ত বৃদ্ধি থেকে পলিপ হতে পারে। পলিপ অক্ষতিকারক এবং ক্যানসার নয়। তবে সময়ের বির্বতনে কিছু পলিপ ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। চিকিৎসকরা তাই নিয়মিত স্ক্রিনিং অর্থাৎ লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই ক্যানসার নির্ণয় করার ওপর জোর দেন। এর ফলে ক্যানসার পরিণত হওয়ার আগেই পলিপ খুঁজে বের করে সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা যায়।
কোলন ক্যানসারের কারণ
ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, মানবদেহে সুস্থ স্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটে একটি সুশৃঙ্খল নিয়মে, যাতে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চালু থাকে। কিন্তু কোষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজন না থাকলেও কোষের বিভাজন হতেই থাকে। এভাবে জমতে থাকা বাড়তি কোষ থেকেই টিউমারের উৎপত্তি। ম্যালিগন্যান্ট বা ক্যানসারে রূপ নিলে ধীরে ধীরে ক্যানসার কোষগুলো আশপাশের সুস্থ কোষ আক্রান্ত করে, লসিকাগ্রন্থিতে ছড়ায়, রক্তপ্রবাহের সঙ্গে মিশে বাসা বাঁধতে পারে দূরের অঙ্গপ্রতঙ্গে।
ঝুঁকি কাদের বেশি
বিভিন্ন ঝুঁকি বা কারণে কোলন ক্যানসার হতে পারে। যেমন-
১. কোলন ক্যানসার যেকোনো বয়সে হতে পারে। তবে বেশি বয়সে, বিশেষ করে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি।
২. আগে কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকলে কিংবা ক্যানসার নয় এমন পলিপ দেখা দিলে পরবর্তী সময়ে কোলন ক্যানসার হতে পারে।
৩. কোলন ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের কেউ কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেশি থাকে। পরিবারের একাধিক সদস্য আক্রান্ত হয়ে থাকলে ঝুঁকি আরো বাড়ে।
৪. বৃহদন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগ যেমন- ক্রোন'স ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. জিনের কিছু অস্বাভাবিক বিবর্তনে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে কোলন ক্যানসার বিস্তৃত হতে পারে।
৬. কম আঁশ ও বেশি চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে কোলন ক্যানসার হতে পারে। অনেক গবেষণায় এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এর ভিন্ন মতও আছে।
৭. যারা কায়িক পরিশ্রম করেন না, তাদের ঝুঁকি বেশি।
৮. অতীতে পেটের ভেতরে কোনো অঙ্গে ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপি নিয়ে থাকলে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
৯. ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মদ ও ধূমপান কোলন ক্যানসারের ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
কোলন ক্যানসারের লক্ষণ
১. মলত্যাগের অভ্যাসের দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন হতে পারে। ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা মলের ঘনত্বের হেরফের হতে পারে।
২. পায়ুপথে কিংবা মলের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে।
৩. মলত্যাগ পুরোপুরি হচ্ছে না এমন মনে হতে থাকতে পারে।
৪. পেটে সারাক্ষণ অস্বস্তির অনুভূত হওয়া, পেটে ব্যথা, কামড়ানো কিংবা অ্যাসিডিটির মতো অনুভূতি।
৫. দুর্বলতা ও অবসাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে।
৬. ওজন কমতে পারে কোনো কারণ ছাড়াই।
কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি প্রথম দিকে কোনো উপসর্গ বুঝতে নাও পারেন। উপসর্গের মাত্রায় তারতম্য হতে পারে বৃহদন্ত্রে রোগের অবস্থান ও আকারের পার্থক্যের কারণে।
কোলন ক্যানসারের চিকিৎসা
ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, প্রধানত অস্ত্রোপচার ও ওষুধ বা কেমোথেরাপির মাধ্যমে কোলন ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়। কোলন ক্যানসারের চিকিৎসায় প্রথম পছন্দ অস্ত্রোপচার, যদি রোগের অবস্থান, ধরন ও ব্যাপ্তি সবকিছু প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে।
অস্ত্রোপচারের আগে কিংবা পরে ওষুধ বা কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয় অনেক ক্ষেত্রে। কেমোথেরাপি ছাড়াও ওষুধের চিকিৎসায় টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি দেওয়া হয় রোগীকে।
কেমোথেরাপির ওষুধ ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। অগ্রসর ক্যানসারের চিকিৎসায় আগে ওষুধ দিয়ে ক্যানসারকে ছোট করে এনে অস্ত্রোপচারের কাজটি সহজ করে নেওয়া হয় অনেক সময়। আবার অস্ত্রোপচারের পর অবশিষ্ট কিংবা গোপন থাকা ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে কেমোথেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়।
কোলন ক্যানসার নিরাময়ে বিকিরণ বা রেডিয়েশন চিকিৎসার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। তবে মলাশয় বা রেক্টাল ক্যানসার চিকিৎসায় অস্ত্রোপচার ও কেমোথেরাপির সঙ্গে বিকিরণ চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
কোলন ক্যানসার প্রতিরোধ
কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। আঁশযুক্ত, ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি খেতে হবে, শস্যজাতীয় উপাদান বেশি খেতে হবে। মদ ও ধূমপান পরিহার করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম ও হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে স্ক্রিনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই রোগ নির্ণয় করতে হবে। ৫০ এর কাছাকাছি বয়সে স্ক্রিনিং শুরু করতে হবে। তবে যাদের ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে তাদের আরো আগে থেকেই স্ক্রিনিং শুরু করতে হবে।
কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর কিছু ওষুধ আছে। তবে তার কার্যকারিতা ও প্রয়োগ নিয়ে মতভিন্নতা থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেসব ওষুধ গ্রহণ করা উচিত নয়।
Comments