ঈদ মৌসুমেও নেই আশানুরূপ বিক্রি, মলিন মুখ তাঁতিদের

অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতি তাদের তাঁত চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/ স্টার

ঈদুল ফিতর আসতে আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। দেশের বৃহত্তম তাঁত শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা ব্যস্ত সময় পার করলেও আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং পাইকারি বাজারে বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক তাঁতি লোকসানের মুখে পড়েছেন।

তাঁতিরা জানান, অন্যান্য বছরের মতো এবার তাঁতপল্লিগুলোতে যাকাতের কাপড়ের চাহিদা তেমন দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি, পার্শ্ববর্তী দেশে তাঁতবস্ত্র রপ্তানি কমে যাওয়ায় পাইকারি বাজারে বিক্রিও কমেছে।

তাঁত কাপড় তৈরির প্রধান উপকরণ সুতার দাম গত এক বছরে ৫০ শতাংশ বাড়লেও কাপড়ের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। এতে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচ তোলা নিয়েও শঙ্কায় প্রান্তিক তাঁতিরা।

তাঁত সমিতির হিসেব মতে নানা সংকটের কারণে অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এ বছর পাবনা ও সিরাজগঞ্জের সাড়ে ৪ লাখ তাঁতের মধ্যে আড়াই লাখের মতো তাঁতে কাজ চলছে।

সিরাজগঞ্জের তাঁত ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলস অ্যান্ড পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মো.  হায়দার আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এ বছর সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও তাঁত কাপরের দাম সেভাবে বাড়েনি।

উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে আশানুরূপ লাভের মুখ না দেখায় প্রান্তিক তাঁতিদের বেশিরভাগই তাদের কারখানাগুলো চালাতে পারছে না বলেও জানান তিনি।

সরেজমিনে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লি ঘুরে দেখা গেছে, উৎসবের মৌসুমেও প্রান্তিক তাঁতিদের অনেকেই তাদের কারখানাগুলো চালাতে পারছে না। অনেকে আবার নিজের কারখানাতেই শ্রমিকের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন।

পাবনা সদর উপজেলার দোগাছি কুলুনিয়া গ্রামের তাঁতি উজ্জ্বল বিশ্বাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তার কারখানায় পাঁচটি তাঁত থাকলেও ক্রমাগত লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে প্রায় দুই মাস আগেই কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

তিনি জানান, ঈদের মৌসুমেও কারখানা চালানোর মতো পুঁজি না থাকায় একজন মহাজন কাপড় তৈরির জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করেছে। তিন ভাই মিলে সেই কাজ করছেন।

'বেকার বসে থাকার চেয়ে নিজের কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে দিনে প্রতিজন ৮/১০ টি লুঙ্গি তৈরি করে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মতো আয় হচ্ছে, এতে কোনরকমে সংসারের খরচ চলে গেলেও কারখানা চালানো সম্ভব নয়।'

কুলুনিয়া গ্রামের তাঁতি আব্দুস সাত্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গত বছর এ সময় এক বান্ডিল সুতা (৮০ কাউন্ট) কিনতে তাঁতিদের গুনতে হয়েছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা।

গত আগস্টের পর থেকেই সুতার দাম বৃদ্ধি শুরু করে, ঈদের মৌসুমের উৎপাদন শুরু হওয়ার আগে আবারও দাম বাড়ে সুতার।

সাত্তার জানান, দুই মাস আগেও এক বান্ডিল সুতা কিনতে হয়েছে ২৬ থেকে ২৮ হাজার টাকায়। এখন এক বান্ডিল সুতা কিনতে তাঁতিদের গুনতে হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কিন্তু বাজারে কাপড়ের দাম সে হারে বাড়েনি। ফলে আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।'

আব্দুস সাত্তার জানান, গত বছর এক থান লুঙ্গি বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা তাঁতিরা লাভ করেছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এবার সুতার দাম বাড়লেও এক থান লুঙ্গি বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকায় এতে প্রতি পিসে ১০ থেকে ১৫ টাকা লাভ তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সুতার ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতীয় সুতার আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে ৮০ কাউন্ট সুতার দাম আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে।

ঢাকার একটি স্পিনিং মিলের ব্যবসায়ী শাকিল আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তাঁত কারখানার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় ৮০ কাউন্ট সুতা। দেশের স্পিনিং মিলগুলোতে ৮০ কাউন্ট সুতা উৎপাদনে খরচ অনেক বেশি পড়ে।

ফলে দেশের চাহিদার বেশিরভাগ ৮০ কাউন্ট আমদানি করা হয় ভারত আর চীন থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে সুতার আমদানি অনেক কমে গেছে ফলে বাজারে ৮০ সুতার দাম বেড়েছে।

এছারাও ৬০-কাউন্ট সুতার দামও বেড়েছে প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ বলে জানান তিনি।

এদিকে তাঁত ব্যবসায়ী ও সংগঠক হায়দার আলী বলেন, সরকার প্রান্তিক তাঁতিদের জন্য শুল্কমুক্ত সুতা আমদানির সুবিধা দিয়ে থাকলেও বেশিরভাগ প্রান্তিক তাঁতিই এ সুবিধা পায় না ফলে প্রান্তিক তাঁতিদের চড়া দামেই সুতা কিনতে হচ্ছে।

ঈদ মৌসুমেও নেই আশানুরূপ ব্যবসা

একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে যখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তাঁতিরা, তখন ঈদের মৌসুমে আশানুরূপ ব্যবসা না থাকায় হতাশ তারা।

শাহজাদপুর কাপড় হাটের ব্যবসায়ী মো. গোলাম হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গত বছর ঈদের মৌসুমে প্রতি হাটে কমপক্ষে ৪০০ থেকে ৫০০ লুঙ্গির থান বিক্রি করতে পারলেও এ বছর ২৫০ থেকে ৩০০ থানের বেশি বিক্রি করতে পারেননি।

শাহজাদপুরে সপ্তাহে দুই হাটে চারদিন বেচাকেনা হয়। অন্যান্য বছর প্রতি সপ্তাহে প্রায় দেড় হাজার থান বিক্রি হলেও এ বছর হাজার খানেক থান বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এবং ভারতে সরবরাহের জন্যও এ হাট থেকে তাঁতের কাপর বিক্রি করা হয়। তবে এ বছর বাইরের ক্রেতাদের সমাগম অনেক কম বলে দাবি করেন তিনি।

শাহজাদপুর হাটের কাপড় ব্যবসায়ী হাজী বদিউজ্জামান বলেন, প্রতি বছর ঈদের সময় এ হাট থেকে সপ্তাহে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার কাপড় বিক্রি হলেও এ বছর প্রতি সপ্তাহে ১০০ কোটি টাকারও কাপড় বিক্রি হচ্ছে না।

প্রতি বছর যাকাতের কাপর সংগ্রহ করার জন্য এ হাটে ভিড় বেশি থাকে তবে এ বছর যাকাতের কাপড় বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় শাহজাদপুর হাটের ঈদের মৌসুমের ব্যবসায় ভাটা পড়েছে বলে জানান তিনি।

পাশাপাশি প্রতি বছর এ হাট থেকে বিপুল সংখ্যক তাঁত কাপড় ভারতের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হলেও এ বছর বাইরের ক্রেতাদের দেখা নেই।

ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁত কাপড়ের পুরো বছরের ব্যবসার সিংহভাগই হয় রমজানে ঈদকে সামনে রেখে। কিন্তু এ বছর সব মিলিয়ে ঈদের আশানুরূপ ব্যবসা নেই। ফলে এ বছর ঈদের মৌসুমে তাঁতিদের মুখেও হাসি নেই।

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

6h ago