চলনবিল নিয়ে ঝুঁকি থাকলেও শর্ত সাপেক্ষে পাস হল রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প

জলাভূমি ভরাট করে ক্যাম্পাস নির্মাণে কয়েকজন উপদেষ্টার আপত্তি থাকলেও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণে ৫১৯ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক)।
গতকাল রোববারের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প অনুমোদন করা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে কাজ করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
একনেক সভায় উপস্থিত থাকা একজন উপদেষ্টা জানান, সভায় বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা চলনবিলের কাছাকাছি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা গড়ে তোলা ব্যাপারে পরিবেশগত দিক তুলে ধরেন। তবে শেষ পর্যন্ত সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের শর্ত পূরণের সাপেক্ষে প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের সম্মতি দেওয়া হয়।
চলনবিলের পানি ডিসচার্জের জন্য বুড়িপোতাজিয়ার গুরুত্ব নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'সব আইনগত দিক যথাযথভাবে বিবেচনা করেই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আইনের বাইরে কোনো কিছুই করা হচ্ছে না।'
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, 'প্রকল্প নিয়ে পরিবেশবিদদের চিন্তার কারণ থাকলেও সেটা মূল্যায়নের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের।'
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের প্রয়োজনীতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'নয় বছর একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ক্যাম্পাস ছাড়া।'
২০১৬ সালে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। বর্তমানে শাহজাদপুরের তিনটি কলেজে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম। ভাড়া করা ভবনে চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।
'শিক্ষা কার্যক্রমের শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের প্রয়োজন। অথচ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নয় বছর পার হয়ে গেলেও নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই।'
জানা গেছে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারির অন্তর্গত বুড়িপতাজিয়ায় ১০০ একর জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
২০১৮ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় একে অকৃষি খাস জমি হিসেবে ছাড়পত্র দিয়েছে।
একনেক সূত্রে জানা গেছে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ৫১৯.১৫ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন হয়েছে। প্রকল্পের মধ্যে আছে–পাঁচ তলার একাডেমি ভবন, পাঁচ তলার প্রশাসন ভবন, পাঁচ তলার প্রশাসনিক ভবন, তিন তলার লাইব্রেরি ভবন।
ডিপিপি অনুযায়ী, ১১টি ফ্যাকাল্টি, ৪০টি ডিপার্টমেন্ট খোলাসহ সাত হাজার শিক্ষার্থীর সংস্থান হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রকল্প পরিকল্পনায় বিশাল খোলা জায়গা আছে। এছাড়া খেলার মাঠ, লেক, কৃষি ও গবাদি পশুর জন্য জায়গা নির্ধারিত আছে।
প্রকল্প এলাকার ৩৩ একর জায়গায় সবুজ বনায়নের পরিকল্পনা আছে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।
তবে প্রস্তাবিত স্থানে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরিবেশবাদীরা। তাদের দাবি, প্রস্তাবিত বুড়িপোতাজিয়া এলাকাটি বড়াল নদী, গোহালা নদী ও চলনবিলের সংযোগস্থল।
সেন্টার ফর এনভারমেনটাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের নির্বাহী পরিচালক ফিদা এ খান বলেন, 'যদি প্রস্তাবিত স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, তাহলে চলন বিলে পানি প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে, যা চলনবিলে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।'
এছাড়া জলাভূমি ভরাট করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রচলিত পরিবেশ আইনে নিষিদ্ধ বলে জানান তিনি।
চলন বিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নই। আমরা শুধু চলনবিলকে বাঁচাতে চাই।'
চলনবিল রক্ষার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা পরিবর্তনের দাবি জানান তিনি।
এর আগে, গত ১০ আগস্ট চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে সদস্য সচিব মিজানুর রহমান পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের জায়গা পরিবর্তনের দাবি জানান।
ঐতিহাসিকভাবে উত্তরের ছয়টি জেলার ৪১ উপজেলার প্রায় হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছিল চলনবিলের বিস্তৃতি। তবে, কালের বিবর্তনে চলনবিল এখন তিনটি জেলার নয়টি উপজেলার ৩৭৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অস্তিত্ব সংকটের ঝুঁকিতে আছে।
৪৭টি নদী, শতাধিক ক্যানেল দিয়ে সারা বছর চলনবিলের পানি প্রবাহিত হলেও এখন বেশিরভাগ জলধারা হারিয়ে গেছে।
পরিবেশবিদরা মনে করছেন, নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে অস্তিত্ব সংকটের ঝুঁকিতে আছে চলনবিল। তাই এর কোল ঘেঁষে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে কফিনে শেষ পেরেক মারার মতো অবস্থা হবে।
পরিবেশবিদদের এই দাবির সঙ্গে একমত নন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এই প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ড. এসএম হাসান তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে চলনবিলের কোনো ক্ষতি হবে না।'
তার দাবি, 'রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী শাহজাদপুরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত জায়গায় ক্যাম্পাস স্থাপনের বাধ্যবাধকতা আছে। তাই স্থান পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।'
তার ভাষ্য, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত স্থান থেকে চলনবিল ৬৮ কিলোমিটার দূরে। তাই চলনবিলের ক্ষতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।'
ভিসি জানান, প্রকল্প এলাকার ৩৩ একর জায়গা বনায়নের জন্য রাখা হয়েছে এবং ২০ একর লেকসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য রাখা হয়েছে। প্রকল্পের ১০০ একর জায়গার মধ্যে ৪২ একর জায়গার ওপর ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হবে। বাকি ৫৮ একর পরিবেশে উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা উপপরিচালক শিবলি মাহমুদ বলেন, 'পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রতিটি পদক্ষেপে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েই করা হবে।'
এদিকে একনেকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পরেই আন্দোলন স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান। এ সময় শিক্ষার্থীরা প্রকল্প অনুমোদন হওয়ায় আনন্দ র্যালি বের করে।
গত ২৬ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস বর্জন করে স্থায়ী ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনে নামে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সড়ক অবরোধ, মহাসড়ক অবরোধ, রেল অবরোধসহ তিন সপ্তাহের বেশি সময় আন্দোলনের পরে শনিবার থেকে অনশনে বসেছিলেন শিক্ষার্থীরা।
Comments