কিংবদন্তি নাদের ‘গুণ্ডা’: পুরান ঢাকার এক নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধা

'মালিটোলার নাদেরের নাম শুনেছেন?' প্রশ্নটি শুনে প্রথমে খানিকটা ভ্রু কুঁচকান পুরান ঢাকার হোসেনী দালান এলাকার বাসিন্দা ফারুক হোসেন। তারপর বলেন, 'নাদেইরা গুণ্ডা? হেরে তো গণ্ডগোলের সময় মিলিটারি মাইরা ফালাইছে! বুকের পাটা আছিল একখান। তবে কখনো সামনাসামনি দেহি নাই।'

রাজধানীর উর্দু রোডের প্রবীণ বাসিন্দা মোহাম্মদ আফজালকেও একই প্রশ্ন করা হলে জবাব আসে, 'নাদেরের নাম শুনলেই মানুষে ডরাইতো। এ কি আইজকাইলের রংবাজ নিকি। পুরানা দিনের রংবাজগো দাপট আছিলো।'

ফারুক, আফজালের কথার সারমর্ম হলো পুরান ঢাকার বাসিন্দারা নাদের নামটির সঙ্গে পরিচিত। তাদের মতো পুরান ঢাকার অনেক স্থায়ী বাসিন্দাই নাদেরকে কখনো না দেখলেও 'মালিটোলার নাদের গুণ্ডা'-র কথা শুনেছেন।

অল্প হলেও নাদেরের বীরত্বগাথার সঙ্গে পরিচিত ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদ জিয়াউদ্দিন বীর প্রতীক। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, 'ক্র্যাকডাউনের কিছুদিন পর, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই। পরে এসে যুদ্ধে যোগ দিই। কিন্তু নাদেররা একদম প্রথমেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ২৫-২৬ তারিখে মূলত ঢাকায় তিন জায়গায় সিভিলিয়ানরা প্রতিরোধ তৈরি করেছিল। এর মধ্যে ইংলিশ রোডে নাদের ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা অন্যতম।'

জিয়াউদ্দিনের তথ্য অনুসারে অন্য দুই প্রতিরোধের জায়গা ছিল, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশের এলাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) পিছনের বস্তি। তবে আগের দুজনের মতো জিয়াউদ্দিন বীরপ্রতীকও নাদেরকে কখনো সামনাসামনি দেখেননি।

'মালিটোলার নাদের মিয়া'-কে মুক্তিযুদ্ধ পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। যুদ্ধের আগে স্রেফ গুণ্ডা বা রংবাজ হিসেবেই তাকে চিনত সবাই। এই নাদেরই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে হয়ে ওঠেন এক সাক্ষাৎ ত্রাসের নাম।

স্বাধীনতা যুদ্ধে নাদেরের অসীম বীরত্বের কথা খুব কম মানুষই জানেন। পুরান ঢাকার প্রবীণ বাসিন্দারা এই নামটি মনে করতে পারলেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রতিরোধের ঘটনাগুলো তেমন মনে নেই তাদের। তাই এই মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের ইতিহাস অনেকটাই কালের স্রোতে ভেসে গেছে।

তার পরিবারকে খুঁজে বের করে নাদেরের উত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান ও পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ঘটনা জানতে দুই সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছে দ্য ডেইলি স্টার। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এক সাহসী তরুণের গল্প।

বীরত্বগাথার এক অনন্য ইতিহাস

পুরান ঢাকার কয়েকটি মহল্লার প্রবীণ বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫ মার্চ রাতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার মুখে অনেক বাঙালি শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। কিন্তু নাদের ছিলেন ব্যতিক্রম। কালরাতের প্রথম প্রহরেই পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন তিনি। কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে রিভলভার আর দোনলা বন্দুক হাতে বংশালের ঈশা ব্রাদার্স ভবনের ছাদে অবস্থান নেন তিনি। করেন পাক বাহিনীকে অতর্কিত আক্রমণের পরিকল্পনাও।

রাত ১২টার পর পাক সেনারা রায়সাহেব বাজার মোড়ের মসজিদ-সংলগ্ন বস্তিগুলোতে আগুন লাগানো শুরু করে। এরপর তারা আগুন দেয় নয়াবাজারের কাঠের মিলগুলোতে।

আগুন দেওয়া শেষ করে সেনাদের জীপ যখন ঈশা ব্রাদার্স ভবনের সামনে আসে, তখনই গর্জে ওঠে নাদের ও তার সঙ্গীদের অস্ত্র। এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল পাক সেনারা। বেশ কজন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন।

এরপর সামলে ওঠে যখন তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে, ততক্ষণে পালিয়ে যান নাদের ও তার সঙ্গীরা।

নাদেরদের ধরতে না পারলেও সে রাতে মালিটোলা-বংশালসহ পার্শ্ববর্তী তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, জিন্দাবাহার লেন, আরমানিটোলা, টিপু সুলতান রোডের মতো অনেক মহল্লায় ঢুকে গণহত্যা চালায় পাক বাহিনী।

২৬ মার্চ সকালে নাদের তার পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে মানিকগঞ্জে রেখে আসেন।

'২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার পর নাদের তার পরিবারকে মানিকগঞ্জে রেখেই আবার মহল্লায় ফিরে আসে। ও আসার পর আমরা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জ চলে যাই,' বলেন মালিটোলার প্রবীণ বাসিন্দা বারেক হাজী।

এরপর শুরু হয় নাদেরদের গেরিলা আক্রমণ। আজ আরমানিটোলা তো কাল সিদ্দিক বাজার, সকালে আলাউদ্দিন রোড তো বিকেলে নারিন্দা, ধোলাইখাল; পরক্ষণেই আবার শ্যামবাজার, বাংলাবাজার, ইংলিশ রোড, টিপু সুলতান রোড, নবাবপুর, জোরপুল, হাটখোলা; পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলি-গলিতে আচমকা হাজির হতেন নাদের ও তার সঙ্গীরা। মুহূর্তের মধ্যে করতেন অ্যামবুশের পরিকল্পনা। পরক্ষণেই অতর্কিত আক্রমণ। নাদেরদের একের পর এক গেরিলা হামলার মুখে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল পাক বাহিনী।

নাদেরের সহযোদ্ধাদের মধ্যে এখন আর কেউ বেঁচে নেই। তবে তাদের মুখ থেকে নাদেরের বীরত্বের গল্প শুনেছেন অনেক। তাঁতিবাজারের বাসাবাড়ি লেনের আবদুল মজিদ তাদের একজন।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'তখন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নাদেরদের অস্ত্র সরবরাহ করতেন সংগ্রাম নামের এক বিহারী। প্রথমদিকে নিজেদের টাকা দিয়েই অস্ত্র কিনতেন নাদের। একসময় তা ফুরিয়ে এলে অস্ত্রের অর্থ সংস্থানের জন্য বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে চাঁদা তুলতে শুরু করেন নাদের।'

ওদিকে পাকিস্তানি বাহিনীও বসে ছিল না। নাদেরদের ধরতে মালিটোলা ও পাশের এলাকায় একাধিক অভিযান চালায় তারা। কিন্তু তবুও নাদেরদের কোনো সন্ধান না মেলায় পাক সেনারা তাদের সহচরদের মোটা অঙ্কের পুরস্কারের লোভ দেখায়।

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় শান্তি কমিটি গঠন করা হলে নিরাপত্তার খাতিরে নাদেরদের চলাচল কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে যায়।

পুরান ঢাকার একাধিক প্রবীণ জানান, মে মাসের শেষদিকে আরমানিটোলায় একটি সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় সেখানকার শান্তি কমিটি। সভায় ঢাকার শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খাজা খয়েরউদ্দিন উপস্থিত থাকবেন বলে বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালানো হয়।

নাদের ও তার সঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নেন, সভায় আক্রমণ চালিয়ে খয়েরউদ্দিনকে হত্যা করবেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সংগ্রামের কাছ থেকে ভারী অস্ত্র কিনেন নাদের।

নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আর্মেনিয়ান গির্জার পাশে অবস্থান নেন নাদেররা। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনার কথা আগেই পাক বাহিনীকে জানিয়ে দেয় সংগ্রাম ও মালিটোলার 'গ্যাদা গুণ্ডা'। নাদেরদের ধরতে পাক সেনারা জিপের বদলে সাধারণ মাইক্রোবাসে চড়ে আরমানিটোলায় আসে। মুক্তিযোদ্ধারা টের পাওয়ার আগেই সাদা পোশাকের পাক সেনারা তাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সংগ্রামও। তার বিশ্বাসঘাতকতা আন্দাজ করে প্রথমে তাকেই গুলি করেন নাদের। এরপর পাক সেনাদের উদ্দেশ্যে পাল্টা গুলি চালান নাদেররা।

কিন্তু ততক্ষণে চারদিক থেকে নাদেরদের ঘেরাও করে ফেলে পাক সেনারা। তবুও পিছু হটার চিন্তা না করে গুলি চালিয়ে যান নাদের। একপর্যায়ে নাদেরের সহোদর হারুনের বুকে গুলি লাগে।

হারুন লুটিয়ে পড়ার পর অনুসারীদের নিয়ে গুলি করতে করতে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন নাদের। পিছু হটার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আরেক মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব।

হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে নাদেরের পায়ে। তবে ততক্ষণে তার অন্য সঙ্গীরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে সক্ষম হন।

নাদেরের চাচাতো ভাই মুন্না মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডান পায়ে গুলি খাওয়ার পরে নাদের কেলাইয়া কেলাইয়া শাবিস্তান হলের ভিতরে গেছে। এরপর দেয়াল টপকাইয়া পাশের বাঘওয়ালা বাড়িতে যাইয়া পলায়। হানুর (হারুনের) লাশও হ্যারা লইয়া গেল।'

কিন্তু রাজাকারদের নিয়ে সেখানেও হাজির হয় পাক সেনারা। জেরা করে বাঘবাড়ির বাসিন্দাদের। তারা প্রাণের ভয়ে নাদেরকে ধরিয়ে দেয়। আটক নাদেরকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় পাক সেনারা। কিন্তু তারা তখনো জানত না, এই ব্যক্তিই সেই 'নাদেইরা গুণ্ডা'।

ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনের মুখেও নিজের বা সঙ্গীদের পরিচয় প্রকাশ করেননি নাদের। একপর্যায়ে গ্যাদা গুণ্ডাকে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হলে সে নাদেরের পরিচয় প্রকাশ করে।

ক্যান্টনমেন্টেই পৈশাচিক নির্যাতন করে নাদেরকে খুন করে পাক সেনারা। এবং তাকে কেমন পাশবিকভাবে মারা হয়েছে, তা বংশাল-মালিটোলা-রায়সাহেব বাজারসহ আশেপাশের এলাকায় সগর্বে প্রচার করে গ্যাদা ও শান্তি কমিটির সদস্যরা।

এই নির্মমতার মধ্য দিয়েই শেষ হয় পুরান ঢাকার এক সাহসী গেরিলা যোদ্ধার বীরত্বের গল্প।

মুক্তিযুদ্ধে নাদেরের সঙ্গীদের মধ্যে আরও ছিলেন আলু বাজারের মোহাম্মদ আলী, সিদ্দিক বাজারের সাদেক, গোলক পাল লেনের চড়ুই সাঈদ, মিরপুরের শামসু ওরফে চেঙ্গিস খান, শ্যামবাজারের আবদুল্লাহ।

মালিটোলার কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দার মতে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর খানেক আগে একটি খুনকে কেন্দ্র করে নাদেরের সঙ্গে গ্যাদার বিরোধ দেখা দিয়েছিল। এই পূর্ব শত্রুতার জেরে গ্যাদা নাদেরকে ধরিয়ে দিয়েছিল বলে ধারণা করেন অনেকে।

তবে গ্যাদার পরিণতিও ভালো ছিল না। চূড়ান্ত বিজয়ের দুদিন আগে মালিটোলায় গ্যাদাকে ধাওয়া করে মহল্লার মানুষ। তখন সে পালিয়ে টিকাটুলিতে যায়। কিন্তু সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। পরে মহল্লাবাসীর সামনে গ্যাদাকে পুরো মালিটোলা প্রদক্ষিণ করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

নাদেরকে নিয়ে কলতাবাজারের ৯০-ঊর্ধ্ব বাসিন্দা নুরু মিয়া বলেন, 'আমার লগে এক পাক আর্মির খুব ভালো পরিচয় ছিল। নাদেরের বিষয়ে হে কইছিল, এরকম চারটা পোলা যদি থাকতো এই দেশ আরও আগেই স্বাধীন হইয়া যাইত।'

হারিয়ে গেছে শাবিস্তান হল, বাঘ বাড়িও

পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নাদের যেখানে শেষ যুদ্ধ করেছিলেন এবং পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলেন সেই আরমানিটোলার চিত্র এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সম্প্রতি আরমানিটোলায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো আর্মেনিয়ান চার্চ এখনো আগের মতো থাকলেও নেই বাঘবাড়ির অস্তিত্ব। আর্মেনিয়ান চার্চ গেটের পূর্ব দিকের একাংশেই ছিল ঢাকার প্রথম সিনেমা হল শাবিস্তান। এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে 'প্রত্যাশা প্লাজা' সহ বেশ কয়েকটি আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন। বাগবাড়ির অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা মহিম সওদাগর বলেন, 'আগে তো চার্চ আর খ্রিষ্টানগো গোরস্থানের লগে পুরোটাই ফাঁকা মাঠ আর খালি জায়গা ছিল। একপাশে শুধু শাবিস্তান হল আর বাঘওয়ালা বাড়ি ছিল। এখন এসব জায়গায় সব বিল্ডিং উইঠা গেছে।'

নাদেরের উত্থান

নাদের মিয়ার জন্ম মালিটোলায়। পেশায় আদালতের মুহুরি বাবার প্রথম সন্তান নাদের পড়াশোনা করেছিলেন জগন্নাথ কলেজে। ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। পুরান ঢাকার একাধিক প্রবীণ বাসিন্দা জানান, ষাটের দশকে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা ছিলেন নাদের। তবে কলেজের গণ্ডি পেরোনোর আগে পাণ্ডা ও রংবাজদের দলে ভিড়ে যান। নাদেরের অন্যতম শাগরেদ ছিলেন দুলু গুণ্ডা। যাকে সবাই পরবর্তীতে নায়ক ফারুক হিসবেই চিনে। ফারুক কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত তার (ফারুক) নামে ৩৭টি মামলা হয়েছিল। নাদের ও দুলুর প্রভাবের কারণে পুরান ঢাকায় আওয়ামী লীগ সমাবেশ করতে গিয়ে কখনো বাধার সম্মুখীন হয়নি।

গুণ্ডা হিসেবে পরিচিত হলেও নাদের ছিলেন মানবিক। একাত্তরের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের সময় রেশন দোকানের দোকানীরা বেশি লাভে বিক্রির জন্য মাল মজুত করতে শুরু করে। ফলে বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেখা দেয় পণ্যের সংকট। যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনারা রেশন দোকানে লুটপাট শুরু করে। এমতাবস্থায় নাদের তার দলবল নিয়ে গোলক পাল লেনের একটি রেশনের দোকান ভেঙে মজুত করা গম চিনি আর চাল এলাকার মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান মালিটোলার একাধিক প্রবীণ বাসিন্দা।

পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাবিবের শৈশব-কৈশোর কেটেছে মালিটোলায়। তিনি বলেন, 'মহল্লার বাইরে নাদেরের হয়তো বদনাম ছিল। কিন্তু মহল্লার মুরুব্বীদের দেখলে তিনি সম্মান করতেন। আমরা যারা ছোট ছিলাম, তাদের ভীষণ স্নেহ করতেন।

শহীদ নাদেরের স্ত্রী শহীদজায়া মনোয়ারা আক্তার। ছবি: স্টার

শহীদ নাদেরের পরিবারের খোঁজে

শহীদ নাদের পরিবারের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বর্তমানে মালিটোলায় শহীদ নাদেরের স্মৃতিচিহ্ন বলতেও কিছুই নেই। সমগ্র মহল্লা খুঁজে একটি দোকানের সানশেডের নিচে ধুলায় জর্জরিত একটি পুরনো সাইনবোর্ড খুঁজে পাওয়া যায়। সাইনবোর্ডটিতে লেখা 'শহীদ নাদের স্মৃতি সংঘ, স্থাপিত: ১৯৭২। যদিও মহল্লাবাসীরা জানান, স্বাধীনতার পর নাদেরের এক ভাই সংঘটি প্রতিষ্ঠা করলেও বাস্তবে এই সংঘের অস্তিত্ব নেই। পাওয়া যায়নি নাদেরের কোনো ছবি বা স্মৃতি চিহ্নও।

মুক্তিযুদ্ধে নাদেরের সঙ্গে তার এক ভাই শহীদ হয়েছিলেন। বর্তমানে শহীদ নাদেরের বাকি ভাইদের পরিবার মালিটোলাতেই থাকেন। তার দুই ভাই এখনো জীবিত। নাদেরের স্ত্রী ও তার একমাত্র ছেলেরও সন্ধান পাওয়া যায়। নাদেরের ছেলে শ্যামবাজারে মশলার ব্যবসা করেন। এক সপ্তাহ আগে শহীদ নাদেরের সেই ছেলের সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। দুদিন বাদে তিনিই তার মায়ের সঙ্গে এই প্রতিবেদককে দেখা করিয়ে দেন।

জীবন যখন উত্থান পতনের

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে টালমাটাল তখন ঢাকার সমস্ত জনপদ। এমনই এক উত্তাল সময়ে বন্ধু হাবিলের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন নাদের। সেখানেই তার ভালো লেগে যায় মেরী নামের একটি মেয়েকে। জানতে পারেন মেয়েটির বাবা নেই, মা থাকে বরিশালে। হাবিলের বাবা মা'ই লালন-পালন করছে তাকে। নাদের সোজা বিয়ের প্রস্তাব দেন বন্ধুর বাবা-মাকে। কিন্তু রাজী হলেন না হাবিলের বাবা-মা। রাজী না হওয়ায় রাতের বেলায় নাদের তার সাঙ্গপাঙ্গ সহ মেয়েটিকে উঠিয়ে অন্যত্র নিয়ে যান। সেখানে বিয়ে করে ফিরে মালিটোলার নিজের বাড়িতে। প্রথমে নাদেরের বাবা-মা রাজী না হলেও কিছুদিন পরে পুত্রবধূকে মেনে নিয়েছিলেন তারা।

বিয়ের পর স্ত্রী মেরীর নাম বদলে মনোয়ারা আক্তার রাখেন নাদের। মনোয়ারা এই প্রতিবেদককে বলেন, 'সব তো ভালাই চলছিল। বাইরে মানুষে গুণ্ডা কইলেও, তার দিল খুব ভালা আছিল। সারাদিন তো বাইরে বাইরেই থাকতো। তয় আমারে খুব ভালোবাসতো।'

মনোয়ারার এই সুখ বেশীদিন টেকেনি। দু বছর বাদেই দেশে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভেই নাদের তার পরিবারকে মানিকগঞ্জে রেখে এসে ফের যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মনোয়ারা সে স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে বলে, 'ঘোড়ার গাড়ি করে সন্ধ্যাবেলা আমরা মানিকগঞ্জের দিকে রওয়ানা দিলাম। আমরা যেখানে গিয়েছিলাম ওখানে থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ টাকা তো উনিই দিতো।'

কিন্তু নাদের শহীদ হওয়ার পর মনোয়ারার জগত পুরোপুরি পাল্টে যায়। স্বামী শহীদ হওয়ার খবর তিনি পেয়েছিলেন মানিকগঞ্জে বসেই। এর কয়েকদিন পরেই ঢাকায় ফিরে আসেন সবাই। মনোয়ারাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে তার মায়ের কাছে। মনোয়ারা তখন অন্তঃসত্ত্বা। যুদ্ধের মধ্যেই জন্ম হয় নাদের-মেরী দম্পতির একমাত্র সন্তানের। যুদ্ধ শেষে কয়েক মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন মনোয়ারা। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে তার ঠাঁই হয়নি।

শহীদ নাদেরের ছেলে আবদুল্লাহ বুলু। ছবি: স্টার

মনোয়ারা বলেন, 'আমারে তো বাড়ি থেইকা একরকম খেদাইয়াই দিলো। কখন কি করে, এই ভাবনায় আর যাই নাই।' একপর্যায়ে ছেলেকে নিয়ে পালক মা-বাবার কাছে চলে গিয়েছিলেন মনোয়ারা। সেখানে কয়েক বছর থাকার পরে পরিস্থিতির কারণে পালক বাবা-মাও তাকে ত্যাগ করে।

ততদিনে মনোয়ারার ভাই কাঞ্চন বরিশাল থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। শেষমেশ ভাইয়ের কাছে গিয়ে উঠেন তিনি। স্বামী নাদেরকে হারানোর ১৭ বছর পরে ১৯৮৮ সালে মনোয়ারার পুনরায় বিয়ে হয় কেরানীগঞ্জের বাঘাশুর গ্রামের বাসিন্দা আম্বর আলীর সঙ্গে। তখন থেকে বর্তমানে স্বামীর বাড়িতেই থাকছেন তিনি। এই সংসারে মনোয়ারার দুই সন্তান।

মালিটোলায় শ্বশুরবাড়ির সমস্ত সম্পত্তি নাদের নিজ হাতে গড়লেও নাদেরের স্ত্রী মনোয়ারার আর কখনোই ঠাঁই হয়নি সেখানে। স্বামী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেও সরকারি সহায়তা পাননি তিনি। মনোয়ারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, 'স্বামীর হক পাইতাম, সেসব তো হ্যারা মাইরাই খাইলো। কিন্তু হের বাপে (পাশে বুলুকে দেখিয়ে) যে যুদ্ধ করলো তারও তো কোনো মূল্যায়ন হইলো না। দেশের লাইগা সে জানটা হারাইল, আমারেও দরিয়ায় ভাসাইলো। যুদ্ধে না গেলে আমার জীবনটা এরকম শেষ হইতো না।'

মনোয়ারা আক্তারের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন তার ছেলে আবদুল্লাহ বুলু। তার চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করছিল। বাবাকে জীবনে কখনোই দেখার সুযোগ পাননি বুলু। কেবল মানুষের মুখে মুখেই শুনেছেন বাবার কীর্তি আর সাহসের কথা। এসবের মাঝেই মনের মধ্যে বাবার একটি অবয়ব দাঁড় করেছেন তিনি। বুলু বললেন, 'যখন মানুষে কয়, তোমার বাপে এমন ছিল, এমন সাহসের কাম করছে; এসব শুনলে খালি চোখ দিয়া পানি আসে। কিন্তু আমার বাপে তো দেশের লাইগাই শহীদ হইছে। কিন্তু এদেশে তার মূল্যায়ন হয় নাই।'

শহীদ নাদেরের স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে আলাপ শেষে আমরা ফেরার পথ ধরি। পথিমধ্যে শহীদ নাদেরের সন্তান বুলু বললেন, 'এর আগে কোন সাংবাদিকের লগে আমার কথা হয় নাই। আপনিই প্রথম কোন সাংবাদিক যে আমারে এতদিন পর খুঁইজা বাইর করলেন।'

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser yunus confirms election date

Election in February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night announced that the general election will be held before Ramadan in February 2026, kickstarting the process of handing over the power to an elected government.

3h ago