ঈদযাত্রা

‘ঝাঁকবাঁধা সারসের মতো উড়ে গেল মানুষের অগণিত মাথা’

জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশনে ২৭ মার্চের ঈদযাত্রার দৃশ্য। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

প্রতি বছর ঈদের ছুটিতে বাস-ট্রেন-লঞ্চে চড়ে ঢাকা থেকে 'নিজস্ব ঠিকানার সন্ধানে' ছুটে চলা মানুষদের নিয়ে কবিতায় এক অসাধারণ চিত্রকল্প এঁকেছিলেন কবি আল মাহমুদ।

ঈদকে সামনে রেখে কোটি মানুষের ঢাকা ছাড়ার এমন দৃশ্যকে কবি তুলনা করেছিলেন ঝাঁকবাঁধা সারসের উড়ে যাওয়ার দৃশ্যের সঙ্গে।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় এসে থিতু হওয়া প্রবাদপ্রতিম এ কবি লিখেছিলেন 'ঝাঁকবাঁধা সারসের মতো উড়ে গেল মানুষের অগণিত মাথা/সদরঘাটের উপচে পড়া ভিড়ের ভেতর দ্যাখো ঘোমটা দেওয়া বধূ/যেন লণ্ডভন্ড বাংলাদেশ কোনো অলৌকিক নিয়মে যূথবদ্ধ হয়েছে/শিশুরা মায়ের পরিধেয় উদোম করে শুষে নিচ্ছে অফুরন্ত ধলেশ্বরী/সকলের চোখেই নদী-মাঠ-শস্যের সীমাহীন সোনার তরঙ্গ/সবকিছু পার হয়ে দেশে ফেরার প্রতিযোগিতা।'

কবিতার উল্লিখিত চরণগুলো কবি ঠিক কোন সময়কালে লিখেছিলেন তা ঠিক জানা যায়নি। তবে নতুন শতাব্দীর সিকি ভাগ পেরিয়ে এসেও এমন দৃশ্যের কোনো হেরফের হয়নি।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

এবারও ঈদুল ফিতর ঘিরে টানা নয় দিন ছুটি শুরুর আগে থেকেই সড়ক, রেল ও নৌপথে ঈদযাত্রা শুরু হয়ে গেছে। তবে আজ শুক্রবার সরকারি ছুটির শুরুর দিন সকাল থেকে সড়ক-মহাসড়কে ঢাকা ছাড়তে থাকা মানুষের ভিড় ছিল তুলনামূলক বেশি।

সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, ঈদে অর্ধেকের বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়েন। মোবাইল ফোন অপারেটরদের তথ্য অনুসারে, গত বছরেও ঈদুল ফিতর উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা ছেড়েছিলেন এক কোটির বেশি সিমধারী।

আজ ভোর থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত পদ্মা সেতুর মাওয়া দিয়ে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে। মাওয়া টোল প্লাজা থেকে তৈরি হয় যানবাহনের দীর্ঘ লাইন।

সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুসারে, এদিন সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চার ঘণ্টায় প্রায় ৫ হাজার মোটরসাইকেল সেতু পার হয়। বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতু দিয়ে পার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার ৬৮৩টি।

এছাড়া যানজট-প্রবণ এলাকাগুলোতে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও এবারের ঈদে বাড়ি ফেরার যাত্রায় দেশের ব্যস্ততম মহাসড়ক ঢাকা-চট্টগ্রামের কুমিল্লা অংশ স্বস্তিতেই পাড়ি দেন মানুষ।

ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

এই মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের ১০৫ কিলোমিটার এলাকার ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে প্রায় এক হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য, দুই শতাধিক রোভার স্কাউট সদস্য এবং সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্য নিয়োজিত আছেন বলে জানায় হাইওয়ে পুলিশ।

এর বাইরে ঈদযাত্রার পঞ্চম দিন আজ সকাল থেকেই কমলাপুর স্টেশনে ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভিড় দেখা যায়। তবে টিকিটবিহীন যাত্রীদের স্টেশনে প্রবেশের সুযোগ না দেওয়ার বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কঠোর সিদ্ধান্তের কারণে কমলাপুরে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়নি। ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ভিড় জমছিল। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভিড় আবার কমে যেতে দেখা যায়।

আর উত্তরের ঈদযাত্রায় দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ থাকলেও চিরাচরিত যানজটের দেখা মেলেনি।

এক সময় ঈদে বাড়ি ফেরার লঞ্চ ধরার জন্য দুপুরের আগে থেকেই ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীরা সদরঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করতেন। তখন গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত তীব্র যানজট লেগে থাকতো। অনেক যাত্রীকে সঠিক সময়ে লঞ্চে উঠার জন্য হাঁটতেও দেখা যেত। রোজার শুরু থেকেই সরগরম থাকতো টার্মিনালের কাউন্টারগুলো। কর্মচারীদের দম ফেলার সুযোগ থাকতো না।

কিন্তু ২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে ওই চিত্র আর নেই। আজও সেখানে চিরচেনা সেই চিত্র চোখে পড়েনি। তবে ঈদের সময় বাসের ভাড়া বৃদ্ধি ও স্বস্তির যাত্রার জন্য অনেকে সড়ক পথ ছেড়ে নৌপথ বেছে নেন। সে কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা যাত্রীর চাপ বেশি থাকায় বাড়তি প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে লঞ্চ মালিকদের।

ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

সরকারি চাকরিজীবীদের 'ছুটির ঈদ'

এবার ঈদে দীর্ঘ ছুটি কাটানোর সুযোগ মিলেছে সরকারি চাকরিজীবীদের। এবার টানা নয় দিন ছুটি কাটানোর সুযোগ পাবেন তারা। এর সঙ্গে ঈদের আগে আরেক দিন ছুটি নিয়ে নিলে তা ঠেকতে পারে ১১ দিনেও।

৩১ মার্চ ঈদুল ফিতর ধরে আগেই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। এর আগে-পরে (২৯ ও ৩০ মার্চ এবং ১ ও ২ এপ্রিল) চার দিন ছুটি থাকছে নির্বাহী আদেশে।

তার আগে আজ ২৮ মার্চ শবে কদরের ছুটি।

সে হিসাবে ২৮ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ছয় দিনের ছুটিতে থাকবেন সরকারি চাকরিজীবীরা।

৩ এপ্রিল নির্বাহী আদেশে ছুটি ঘোষণা করায় আরও তিন দিন যুক্ত হয়েছে ছুটির তালিকায়। কারণ এর পরের দুই দিনই শুক্র ও শনিবার।

ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

সরকারি চাকরিজীবীদের শেষ অফিস ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ (বৃহস্পতিবার)। এর আগের দিন আবার ছিল ২৬ মার্চের ছুটি।

সে হিসাবে, ঈদের আগের বৃহস্পতিবার যাদের ছুটি মিলেছে তারা এবার টানা ১১ দিন ছুটি কাটাতে পারবেন।

ফেরা যাক প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা আল মাহমুদের কবিতায়। ঈদের ছুটিতে হাজারো কষ্ট মাড়িয়ে কেন রাজধানী থেকে মানুষের মিছিল 'দেশ' অর্থাৎ নিজস্ব ঠিকানায় ছুটে চলে তার একটি জবাব পাওয়া যাবে কবিতার এ অংশে—'দ্যাখো গমনোদ্যতদের ঠিকানা তাদের প্রতিটি মুখাবয়বে, চেহারায়/সেখানে নদীর কিনারায় মুদ্রিত একটি করে গ্রাম/সাধ্যমতো ঘরবাড়ি, গৃহস্থালি, রান্নার আগুন আর মরিচের গন্ধ/বিদ্যুৎহীন আধো অন্ধকারে রাধুনীর মুখ/মা কিংবা নিগূঢ় ভালোবাসার প্রগাঢ় প্রতিচ্ছবি/…এইতো দেশ/যেখানে পৌঁছাতে হাজারো কষ্ট মাড়িয়ে চলে মানুষের মিছিল/সেখানে পৌঁছাতে যে পারল না তার আবার ঈদ/তার আবার দেশ।'

Comments

The Daily Star  | English
Pathways to a new political order

Pathways to a new political order

The prospects for change are not without hope in Bangladesh.

9h ago