গুমে জড়িতদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন

ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

গুমের শিকার কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে অন্য কেউ দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করতে যাচ্ছে সরকার।

'গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ ২০২৫' নামে এক খসড়া অধ্যাদেশে গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সর্বনিম্ন ১০ বছরের জেল এবং জরিমানার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।

আইনটি হলে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জোরপূর্বক গুমের একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এর সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের ফৌজদারি আদালতে বিচার করা সম্ভব হবে। এতদিন অপহরণ বা কিডন্যাপিংয়ের মতো বিষয়গুলো ফৌজদারি আইনে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

অপরাধীদের সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড রাখার প্রস্তাবও করা হয়েছে খসড়া অধ্যাদেশে।

গতকাল মঙ্গলবার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই আইনের ওপর অংশীজনদের সঙ্গে এক আলোচনায় খসড়াটি উপস্থাপন করে। প্রথমবারের মতো হওয়া এই আলোচনায় নির্বাচিত আইনবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা অংশ নিয়ে তাদের মতামত দেন। এই খসড়া নিয়ে আরও আলোচনা হবে।

খসড়া আইনে অভিযুক্তদের অনুপস্থিতিতেও বিচার করার সুযোগ রাখা হয়েছে। যদি যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ পাওয়া যায় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি আত্মগোপনে চলে গেছেন, তাহলে চার্জশিট গ্রহণের ২০ দিনের মধ্যে আদালত একটি নোটিশ জারি করে তাকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতে পারবে।

যদি আসামি নোটিশে উল্লেখিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে হাজির না হয়, তাহলে আদালত তার অনুপস্থিতিতেই মামলার বিচারকাজ শুরু করতে পারবে বলে প্রস্তাব করা হয় খসড়ায়।

এই অধ্যাদেশে গুম সংক্রান্ত অপরাধের বিচারে ৬৪ জেলায় ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা এই অধ্যাদেশ জারির ৬০ দিনের মধ্যেই কার্যকর করা হবে। ট্রাইব্যুনাল না হওয়া পর্যন্ত জেলা দায়রা জজ আদালতের এ ধরনের অপরাধের বিচার শুরু হবে।

এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধগুলো হবে আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য এবং আপস অযোগ্য। অর্থাৎ, একবার মামলা দায়ের হলে, তা আদালতের বাইরে মীমাংসা করার কোনো সুযোগ থাকবে না।

ঢাকায় জুডিশিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত আলোচনায় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, 'হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ গুম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এটি আরও জঘন্য।'

তিনি বলেন, সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে গুম, হত্যাকাণ্ড এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলোর বিচার নিশ্চিত করা, বিশেষ করে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

তারা এমন একটি ব্যবস্থা চান যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে ক্ষমতায় আসতে না পারে এবং সেই লক্ষ্যেই বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা।

খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে কোনো সরকারি কর্মচারী, অথবা রাষ্ট্র বা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, সমর্থন বা মৌন সম্মতিতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী (ক) যদি কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ অথবা অন্য কোনোভাবে স্বাধীনতা হরণ করে এবং (খ) সেই ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করার বিষয়টি অস্বীকার করে অথবা ওই ব্যক্তির নিয়তি বা অবস্থান গোপন করে রাখে তাহলে তা গুম হিসেবে গণ্য হবে।

এছাড়া যদি কোনো ব্যক্তি উপরে উল্লিখিত দুটি উপধারায় উল্লিখিত কোনো অপরাধ সংঘটিত করার চেষ্টা করে; ওই ধরনের অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ দেয়, সহায়তা করে বা প্ররোচিত করে; অথবা এই ধরনের অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করে তবে তাকেও এই আইনের অধীনে বিচার করা যাবে।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, গুমের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি দেশে যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জরুরি অবস্থা—এসব বলেও পার পাওয়া যাবে না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশেও যদি কেউ এমন অপরাধ করে, তবুও অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে।

খসড়ায় নিজের মতামত জানাতে গিয়ে সাবেক কূটনীতিক এম মারুফ জামান, যিনি নিজেও গুমের শিকার হয়েছেন, বলেন, আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা উচিত নয়। কারণ এই আইনটি একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে বাংলাদেশ সম্প্রতি সই করেছে।

তিনি বলেন, 'যদি মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাদ দেওয়া হয় তাহলে এই অধ্যাদেশের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে।'

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন দেশের প্রতিটি জেলায় ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য সুপারিশের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, তার চেয়ে এ ধরনের অপরাধের তদন্ত ও মামলা প্রক্রিয়ায় যে বিপুল সাহসী ‌ও দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হবে, তার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।

মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার'-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সায়রা রহমান খান বলেন, অধ্যাদেশে ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি তিনি ভুক্তভোগী এবং সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করার বিধান রাখার কথা বলেন। তিনি এমন একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানান যেখানে গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার ভুক্তভোগীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং অন্যান্য সম্পদে তাদের অধিকার পায়।

মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিনও ক্ষতিপূরণের পক্ষে মত দেন।

আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, যদি গুমের ঘটনা ব্যাপক ও পদ্ধতিগত হয়, তাহলে সেগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেও বিচার করা যেতে পারে। তিনি কোন মামলাগুলো নতুন ট্রাইব্যুনালের অধীনে এবং কোনগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে বিচার করা হবে, তা নির্দিষ্ট করার কথা বলেন।

প্রধান আইসিটি প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, অধ্যাদেশে তদন্তকারী দল অপরাধের তদন্তে কতটা গভীরে যেতে পারবে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত। বিশেষ করে, তদন্তকারী সংস্থা কীভাবে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ও সশস্ত্র বাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করবে, তা নির্ধারণ করা জরুরি।

এই আইনের উদ্যোগ নেওয়ার আগে গত বছরের ২৯ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার 'গুম থেকে সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন'-এ যোগদানের দলিলে সই করেছে। তারও আগে সরকার শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সংঘটিত গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে।

চলতি বছরের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুমের শিকার ব্যক্তিদের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ধরে বেশ কয়েকটি গোপন নির্যাতনকেন্দ্রে (যা আয়নাঘর নামে পরিচিত) অমানবিক অবস্থায় আটকে রেখেছিল।

তদন্তের সময় কমিশন ৭৫৮টি গুমের অভিযোগ পায়। এর মধ্যে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের (২৭ শতাংশ) বেশি আর কখনোই ফিরে আসেননি। কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল—গুমের সংস্কৃতি ১৫ বছর ধরে পদ্ধতিগতভাবে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে তা সহজে ধরা না পড়ে।

Comments

The Daily Star  | English

Govt relieves Kuet VC, Pro-VC of duties to resolve crisis

A search committee will soon be formed to appoint new candidates to the two posts

1h ago