সাংবাদিকের প্রশ্নের উদ্দেশ্য ও চাকরিচ্যুতির কারণ—উভয়ই ‘ঘোলাটে’

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে 'বিতর্কিত' প্রশ্ন করা এবং সেই ঘটনার পর তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির ঘটনায় চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকে বলছেন, সাংবাদিকদের ওই প্রশ্নগুলো যেমন 'পেশাদারিত্ব বজায় রেখে' করা হয়নি, তেমনি এই ঘটনার পর তাদের চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সরকার কাউকে চাকরিচ্যুত করতে বলেনি।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সেলিম রেজা নিউটন, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (বাম দিক থেকে)। ছবি: সংগৃহীত

সাংবাদিকদের করা ওই প্রশ্নগুলো 'উসকানিমূলক' ছিল উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সাংবাদিকদের ওই প্রশ্নগুলো ঠিক হয়নি। সেখানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাবলীর প্রতি সংবেদনশীলতার অভাব ছিল। প্রশ্নগুলো ছিল ভুল ও অসঙ্গত।

কিন্তু যুক্তিসঙ্গত উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে সেগুলোর মোকাবিলা করাই ভালো পথ বলে মনে করে তিনি। 'কিছু উত্তর উপদেষ্টা দিয়েছেনও। কিন্তু এরপর যে ঘটনা ঘটেছে, তা ভালো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেনি। তাদের চাকরি যাওয়া কিংবা চ্যানেলের নিউজ সম্প্রচার বন্ধ করার ক্ষেত্রে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।'

তিনি বলেন, যেই সাংবাদিকরা ওই প্রশ্নগুলো করেছেন, তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন বুঝে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারত কিংবা তাদের শোকজও করতে পারত। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়া বা সঙ্গে সঙ্গে নিউজ সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় খুব খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হলো।

'সাংবাদিকদের প্রশ্নের মধ্যে দুর্বলতা থাকতে পারে বা সমস্যা থাকতে পারে। সেটার জন্য চাকরি যাওয়াটা আমি ঠিক মনে করি না। এটা একটা হুমকিও। কারণ অন্য সাংবাদিকদেরও তখন মনে হবে যে, কী প্রশ্ন করব, তার প্রতিক্রিয়া কী হবে। এখন তো ফেসবুক কিংবা অন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে মব-ট্রায়ালের মতো বিচার হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে কারো পক্ষে স্বাধীনভাবে চিন্তা করাও ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতে পারে। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতা কিংবা সাংবাদিকদের কাজের জন্য এটা অসুবিধা।

ওই তিন সাংবাদিকের করা প্রশ্ন নিয়ে সেলিম রেজা নিউটনের ভাষ্য, প্রশ্নগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়েছে, এগুলোর মাধ্যমে সারা পৃথিবীর সামনে ঘটা গণহত্যাকে ডিনাই করা হয়েছে এবং এটা পলিটিক্যালি মোটিভেটেড একটা ডিনায়াল। যেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই মাস মার্ডারিং হয়েছে, সেখানে যদি বলা হয় শেখ হাসিনাকে খুনি বলা যাবে না, সেটা তো এই গণহত্যাকে জায়েজ করা কিংবা গণহত্যাকে ডিনায়ালের চেষ্টা।

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী খুবই ম্যাচিউরডলি পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, উপদেষ্টা একটুও মেজাজ হারাননি। এটা মেজাজ হারাবার মতো ঘটনা। ভয়ংকর খারাপ লাগার মতো ঘটনা। কিন্তু তিনি যথাযথভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা বেশ প্রশংসনীয়।

সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রসঙ্গ বলে মনে করেন রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনায় আমি মনে করি না যে সরকার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। দীপ্ত টিভি সম্প্রচার বন্ধ করার পেছনে অলাভজনক অবস্থায় থাকার একটা ইস্যু আছে। আরেকটা দিক হচ্ছে, এই ধরনের প্রশ্নে মানুষের মধ্যে জনরোষ তৈরি হয়েছে, যা খুবই স্বাভাবিক। সেই রোষকেও তো হাউসগুলো বিবেচনায় নিতে বাধ্য হবে। কিন্তু এটার সঙ্গে সরকারকে জড়িত করাটা আমার কাছে ন্যায্য মনে হয় না।

ওই টিভিগুলো কেন সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করেছে, সেই বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে সেলিম রেজা নিউটন বলেন, ওই গণমাধ্যমগুলোর ইন-হাউস পলিসি কেমন, সেখানে ডিসিশন মেকিং কীভাবে হয়, কেন তারা চাকরিচ্যুত করল, ভেতরকার ইস্যু আসলে কী, ওই সিদ্ধান্ত তারা কীসের ভিত্তিতে নিয়েছে, আসলেই সরকারি কোনো মহল থেকে বা কারো চাপ ছিল কি না—এগুলো বের করা প্রয়োজন। সাংবাদিকতার স্বার্থেই এই অনুসন্ধান প্রয়োজন। সাংবাদিকদের কর্তব্য সেটা বের করা।

সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে করা প্রশ্নগুলো 'আপত্তিকর' ছিল উল্লেখ করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, এই ঘটনায় খুবই অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। এখন এই প্রশ্নগুলো আমাকে করলে আমিও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতাম। কিন্তু তার মানে এই না যে কারো চাকরি চলে যাবে। তাদেরকে সতর্ক করা যেতে পারত। কিন্তু চাকরিচ্যুত করার আচরণটা ফ্যাসিস্টের মতোই তো হয়ে গেল। আওয়ামী লীগ তাই করত। আরও খারাপ কিছু তারা করত, মামলা দিত, জেলে ঢোকাত, আয়নাঘরে আটকে রাখত...

এই ঘটনা এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, আলী রীয়াজের খুব বিখ্যাত একটি বই 'ভয়ের সংস্কৃতি'। এখন তাদের সময়েও একই রকমের ভয়ের পুনরুৎপাদন হচ্ছে। এটা খুবই অ্যালার্মিং এবং এ ধরনের চর্চাগুলো হওয়া উচিত না।

'কোনো প্রশ্নে যদি কেউ অফেন্ডেড হয়ে থাকেন, তাহলে যুক্তি ও সঠিক উত্তর দিয়ে সেটা এনকাউন্টার করা যায়। কিন্তু চাকরি যাওয়ার মতো সিচুয়েশন তৈরি হওয়াটা সঠিক হয়নি।'

Comments

The Daily Star  | English
Secretariat employees protest against 'stricter' govt service law

Secretariat employees protest against 'stricter' govt service law

From 9:30am, officers and staff started gathering in front of building no. 6 at the Secretariat's Badamtola.

1h ago