ম্যানিপুলেটর কারা, কীভাবে এড়াবেন

খেয়াল করে দেখুন, আপনার জীবনে কোনো না কোনো সময় এমন কেউ এসেছেন যার কথায় আপনি সিদ্ধান্ত বদলেছেন, নিজের জীবন নিয়ে নেওয়া কোনো পরিকল্পনার বদল ঘটিয়েছেন। কিছুদিন পরে নিজেই হয়তো ভেবে ভেবে অস্থির হয়েছেন যে, কেন ওই ব্যক্তির কথায় সিদ্ধান্ত বদলালেন। কিন্তু যে সময় ওই ব্যক্তি আপনার জীবনে ছিলেন, তখন তিনি আপনার ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিলেন যে তার কথার বাইরে আপনি যেতেই পারেননি।
যে ধরনের ব্যক্তির কথা বলছি, তাদেরকে বলা হয় ম্যানিপুলেটর। যার আভিধানিক অর্থ, এমন একজন মানুষ যিনি তার নিজের সুবিধার জন্য অন্যদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেন, প্রয়োজনে তার জন্য অন্যায় বা অসৎ পন্থাও অবলম্বন করেন।
যদি খুব সাধারণভাবে চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন ম্যানিপুলেটররা কারো জীবনেই ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসেন না। যেহেতু তারা কেবল নিজের কথাই ভাবেন, নিজের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেন তাই তাদের কথায় প্রভাবিত হলে অপরপক্ষের কেবল ক্ষতিই হয়। তাই যতটুকু সম্ভব ম্যানিপুলেটরদের এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
এই ধরনের ব্যক্তিদের এড়িয়ে চলতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ম্যানিপুলেশন কী, ম্যানিপুলেটর কারা। এরপর জানতে হবে, তাদের কীভাবে চেনা যাবে এবং কীভাবে তাদের এড়িয়ে চলতে হবে।
ম্যানিপুলেশন কী
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানব স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বিষয়ক ওয়েবসাইট ওয়েবএমডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ম্যানিপুলেশন হলো অন্যের ওপর চাপ প্রয়োগ করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করা। কখনো কখনো নিজের ইচ্ছা পূরণে এজন্য নেওয়া হয় অন্যায় পন্থাও। ম্যানিপুলেটররা সাধারণত অন্যের আবেগ খুব সহজেই ধরতে পারেন। আর সেই দক্ষতা ব্যবহার করে তারা অপর ব্যক্তির দুর্বলতা খুঁজে বের করেন এবং তার সুযোগ নিয়ে নিজের সুবিধা আদায় করেন।
ম্যানিপুলেটরের এ ধরনের আচরণের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো তার ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনের জন্য বিশেষ ক্ষমতা অর্জন। আর এটা করতে গিয়ে প্রায়ই তারা সম্পর্কের সীমারেখা ভুলে যান, অন্যের জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে তারা যেকোনো অন্যায় করতেও পিছপা হন না।
এ ধরনের আচরণের কারণে দুজন ব্যক্তির মধ্যে ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনে এক ধরনের বৈষম্যমূলক সম্পর্ক তৈরি হয়, যা দুজনের মধ্যে তৈরি করে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। প্রথম প্রথম এটি হয়তো ক্ষতিকর বলে মনে হয় না, কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা সম্পর্কে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। যার ফলে ম্যানিপুলেশনের শিকার ব্যক্তিটি কখনো কখনো বিভ্রান্ত, কখনো উদ্বিগ্ন এবং ক্লান্ত বোধ করতে পারেন।
কারা ম্যানিপুলেটর
সাধারণত কারা আপনার জীবনে ম্যানিপুলেটরের ভূমিকা পালন করেন সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট ভেরি ওয়েল মাইন্ড।
তাদের মধ্যে থাকতে পারেন এমন কেউ, যিনি আপনার দুর্বলতা জানেন এবং বিষয়টিকে নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করেন। এমন কোনো ব্যক্তি, যিনি আপনার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কাছ থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন এবং তার ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করছেন।
যে ব্যক্তি সত্য গোপন রাখেন, অকারণে মিথ্যা বলেন এবং তাদের কোনো কাজের জন্য দায়িত্ব না নিয়ে উল্টো আপনাকেই দোষারোপ করেন। এমন ব্যক্তি যে ক্রমাগত আপনাকে নিয়ে উপহাস করেন বা ঠাট্টা করেন, যার ফলে আপনি নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে থাকেন।
এছাড়া এ ধরনের ব্যক্তি সম্পর্কে গ্যাসলাইটিং করেন এবং রাগ বা ঝগড়ার সময় সরাসরি কথা না বলে উল্টো আক্রমণাত্মক কথা ব্যবহার করেন।
তারা ক্রমাগত আপনার নামে অভিযোগ করেন, আপনার সঙ্গে এমন আচরণ করতে থাকেন যে আপনার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের ব্যক্তিরা আপনার সঙ্গে অন্যের তুলনা করেন। এমনকি তারা আপনাকে বন্ধু-স্বজনদের কাছ থেকেও দূরে নিয়ে যান।
কীভাবে বুঝবেন ম্যানিপুলেশনের শিকার হচ্ছেন
একজন ম্যানিপুলেটরের তার আচরণের পেছনে কিছু কারণ থাকে। কেউ কেউ জবাবদিহিতা এড়াতে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করতে এ ধরনের আচরণ করেন। আবার কেউ কেউ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে এ ধরনের আচরণ করেন।
একজন ম্যানিপুলেটর আপনাকে আপনার পরিচিত জায়গা বা সুবিধাজনক অবস্থান থেকে বের করে আনতে চেষ্টা করবেন। যার মাধ্যমে তিনি নিজের কোনো সুবিধা অর্জন করবেন কিংবা আপনার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবেন।
তিনি যেকোনো ঘটনার দায় আপনার ওপর চাপাতে চেষ্টা করবেন। কৌশলগতভাবে আপনার সঙ্গে তথ্য শেয়ার করবেন, যার পুরোটা সত্য নাও হতে পারে। তিনি সবসময় মনে করেন যে এসবের মাধ্যমে আপনার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছেন।
তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে অনেক সময় ছলনার আশ্রয় নেন, মিথ্যা কথা বলে আপনার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন। আবার কখনো কখনো মজার ছলে আপনার দুর্বল জায়গায় আঘাত দেন। এর মাধ্যমে আসলে আপনাকে অনিরাপদ বোধ করাতে চান।
ম্যানিপুলেটর চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো গ্যাসলাইটিং শনাক্ত করা। তারা আপনাকে বিভ্রান্ত করার সবরকম আয়োজন করে রাখেন। যখন আপনি সত্যিই সেই ঘটনার মুখোমুখি হন তখন ম্যানিপুলেটর আপনাকে বলেন যে, এটি কখনো ঘটেইনি।
ম্যানিপুলেটররা কখনো কখনো আগ্রাসী ভূমিকা নেন না। বরং তারা রাগ প্রকাশ ও আপনাকে দুর্বল করার জন্য সূক্ষ্ম ও পরোক্ষ উপায় অবলম্বন করেন, যা আপনি ছাড়া অন্য কারো চোখে ধরা পড়ে না।
ম্যানিপুলেটররা ক্রমাগত সমালোচনার মাধ্যমে আপনাকে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখেন। সামাজিকভাবেও তারা আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান।
ম্যানিপুলেটরের আরেকটি কৌশল হলো তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে জানানো। এতে আপনি পরিস্থিতি ঠিকঠাক বুঝতে পারবেন না, ফলে বিভ্রান্ত হবেন। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন, যেন তার জন্য আপনিই নিজেকে দায়ী মনে করেন। এতে তারা যা চান, সহজেই তা পেয়ে যেতে পারেন।
ম্যানিপুলেটরের কৌশলী আচরণের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হলো, নীরবতার মাধ্যমে আপনাকে উপেক্ষা করা এবং শাস্তি দেওয়া। কখনো কখনো তারা আপনাকে ছোট করার জন্য অন্যের সঙ্গে তুলনা করেন, অন্য সবার মতো হতে আপনাকে প্ররোচিত করেন।
কীভাবে বাঁচবেন
ম্যানিপুলেটরদের কাছ থেকে বাঁচতে প্রথমেই আপনাকে নিজের চারপাশে একটা সীমানা তৈরি করতে হবে। যে কেউ যেন চাইলেই সেই সীমা অতিক্রম করতে না পারেন সেদিকে নজর দিতে হবে। কর্মক্ষেত্র হোক আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক; নিজের সীমানার ভেতরে কাউকে প্রবেশ করার অধিকার দেবেন না। তা তিনি আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা যাই হোক না কেন। কারণ প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র, প্রত্যেকেরই কিছু নিজস্বতা থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি সম্পর্কে এই সীমানা মেনে চলা হলে সেই সম্পর্ক সুস্থ থাকে, ভালো থাকে।
আপনাকে 'না' বলতে শিখতে হবে। সবার সব কথায় হ্যাঁ বলা যাবে না। মনে রাখবেন, আপনি একসঙ্গে সবাইকে খুশি রাখতে পারবেন না। তাই ততটুকুই করুন, যতটুকু আপনার সাধ্যের মধ্যে রয়েছে।
যদি বুঝতে পারেন যে কেউ আপনাকে ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করছে তাহলে তার থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকুন। পেশাগত কারণে মিশতে হলেও সীমানার মধ্যে থাকুন।
নিজের বা পরিবারের খুব গোপন কথা কারো সঙ্গে সহজেই ভাগ করে নেবেন না। ম্যানিপুলেটররা এসব কথা থেকেই আপনার দুর্বলতা খুঁজে বের করেন।
যতটুকু সম্ভব নিরাবেগ থাকার চেষ্টা করুন। ম্যানিপুলেটররা অনেক সময় নাটক করতে চেষ্টা করেন, সেসবে মনোযোগ দেবেন না। বরং কৌশলে এড়িয়ে চলুন।
কারো কথায় একমত হওয়ার আগে একটু সময় নিন। কেউ কৌশলে আপনার কাছে কিছু চাইলে তাতে মতামত দেওয়ার আগে ভাবুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, তারপর ভেবে উত্তর দিন।
ম্যানিপুলেটরের চিকিৎসা
দীর্ঘদিন ধরে এই আচরণ চালিয়ে যাওয়া ব্যক্তি সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তার সঙ্গে পরিবার, বন্ধু, স্বজন, সহকর্মীসহ সবার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। কারণ একটা সময় গিয়ে ঠিকই ধরা পড়ে যে তিনি একজন ম্যানিপুলেটর।
অনেক সময় ম্যানিপুলেটর নিজেও বুঝতে পারেন যে তিনি একটি মানসিক সমস্যার জালে আটকা পড়েছেন। সেসময় তার উচিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়া। একমাত্র তারাই ম্যানিপুলেটরকে স্বাভাবিক জীবনে, স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরতে সহায়তা করতে পারেন।
Comments