সঙ্গী ম্যান-চাইল্ড হলে কী করবেন
ম্যান ও চাইল্ড দুটি বিপরীতধর্মী শব্দ। তাহলে এই শব্দ দুটিকে একসঙ্গে করে কী বোঝায়? চলুন উদাহরণ দিই, তাহলে বুঝতে সহজ হবে।
এই তো ছয় মাস আগেই বিয়ে হলো রাকিব ও আফসার। বিয়ের আগেই জানাশোনা ছিল তাদের। রাকিবের শিশুসুলভ সরল আচরণ আফসাকে মুগ্ধ করেছে বরাবর। কিন্তু বিয়ের পর দেখা গেল, গভীর রাত অব্দি ভিডিও গেমসে মত্ত থাকা কিংবা রাতভর নেটফ্লিক্সে ডুবে যাওয়া রাকিবের নিত্যদিনের রুটিন। বাইরের জাঙ্কফুডেও আসক্ত তিনি। অফিসে যেতে দেরি হয়। তাই তার চাকরিও বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
আপনার জীবনসঙ্গীর সঙ্গে বা আপনার নিজের সঙ্গেই রাকিবের কোনো একটা লক্ষণ কি মিলে যায়? যদি মিলে যায় তাহলে এটাকে বলা হয় 'ম্যান-চাইল্ড' বা 'পিটার প্যান সিনড্রোম'। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হলেও কারো আচরণ শিশুদের মতো।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মাহবুব আজাদ।
ম্যান-চাইল্ড কারা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহাবুব আজাদ বলেন, নিজের আবেগ-অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা, সমালোচনা না নিতে পারা, দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা কিংবা অপরাগ, টাকা-পয়সা হিসাব করে খরচ করতে না পারা, চাপ সামলে চলতে না পারা, পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা, এক কথায় বয়সের সঙ্গে পরিণত আচরণ না করার লক্ষণ মানেই তিনি ম্যান-চাইল্ড। এটি ক্লিনিক্যালি সার্টিফাইড কোনো মানসিক রোগ নয়। তবে যাদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা রয়েছে তাদের সঙ্গীদের কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
কাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি ও কেন
ম্যান চাইল্ড সাধারণত পুরুষদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। নারীদেরও হিসাব থেকে বাদ দেওয়া যাবে না, তবে সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। পুরুষদের অপরিণত আচরণের অন্যতম কারণ হলো বেড়ে উঠার সময়ে ছেলে সন্তান হিসেবে বেশি সুবিধা পাওয়া। সমস্যা থেকে ছেলেদের দূরে রাখা হয়। বাবা-মা চেষ্টা করেন ছেলেদের জন্য একটু বেশি কমফোর্ট জোন তৈরি করার। বেড়ে উঠার সময় পাওয়া বাড়তি সুবিধা পরিণত বয়সে শিশুসুলভ আচরণের অন্যতম কারণ।
তাছাড়া সন্তানদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ, ছেলেকে একপক্ষীয় অনৈতিক সমর্থন, অতিরিক্ত আহ্লাদ পিটার প্যান সিনড্রোমের জন্য দায়ী বলে জানান ডা. মাহবুব আজাদ।
তিনি আরও বলেন, ছেলেদের সাধারণত শাসন করা হয় কম। তাছাড়া ঘরের কাজগুলোর মত ছোট ছোট কাজগুলোর অভ্যাসও করানো হয় না। আবার অন্যদিকে সন্তান গ্রহণ নীতির কারণেও ম্যান চাইল্ডের লক্ষণ প্রকাশ পায়। পরিবারের একমাত্র সন্তান হলে গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তারা। তাদের ভেতরে সবকিছুই 'ফর গ্রান্টেড' হিসেবে নেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়, যা তাদের ম্যান-চাইল্ড হয়ে উঠার অন্যতম কারণ।
আপনার সঙ্গী কী একজন ম্যান-চাইল্ড?
সম্পর্কে শুরুতে সঙ্গীর সরলতা আপনাকে মুগ্ধ করতেই পারে। কিন্তু সেটি তার সরলতা নাকি তিনি ম্যান চাইল্ড সেটি কীভাবে বুঝবেন?
ডা. মাহবুব আজাদ বলেন বেশির ভাগ সময়ে বয়সের তুলনায় অপরিণত আচরণ করে থাকেন ম্যান-চাইল্ডরা। কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। কোনো ব্যক্তিগত কথা বললে বাবা-মা বা বন্ধুদের কাছে শেয়ার করে ফেলেন। অনেক সময় কথা গোপন রাখতে পারেন না। কোনো ধরনের সমালোচনা মেনে নিতে চান না। হুটহাট রেগে যাওয়া, ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে না পারা, সম্পর্ক রক্ষা করতে না পারা, পরিস্থিতি বুঝে আচরণ বা মন্তব্য করতে না পারা,গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়েও উদাসীনতা পিটার প্যান সিনড্রোমের লক্ষণ।
তাছাড়া শিশুদের মতো ভিডিও গেমসে আসক্ত থাকা, পেশাগত জীবনে ও দায়িত্ব অবহেলা, শখের বশে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও ম্যান-চাইল্ডের লক্ষণ। খেয়াল করলে দেখা যাবে তাদের বন্ধু-বান্ধবও এই ধরনের।
সঙ্গী ম্যান-চাইল্ড হলে করণীয়
সঙ্গী ম্যান-চাইল্ড হলে কী করবেন এ বিষয়ে ডা.মাহবুব আজাদের পরামর্শ হলো, 'সহানুভূতি দেখান। ধৈর্য ধরে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করুন। কোনোভাবেই রাগ করে, চিৎকার করে আপনার সঙ্গীর আচরণ বদলাতে পারবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।'
তিনি যেহেতু শিশু মন নিয়ে চলছেন তাই প্রাথমিকভাবে আপনি তার জন্য রোল মডেল।
তাই নেতিবাচক আচরণ করে নিজেদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দিবেন না। তাকে ছোট ছোট দায়িত্ব দিন, দায়িত্ব পালন করার পর তাকে উৎসাহিত করুন, প্রশংসা করুন। তিনি ম্যান-চাইল্ড হলেও কিন্তু শিশু নন, তাই চিৎকার চেঁচামেচি না করে যুক্তি দিয়ে বোঝান।
প্রয়োজনে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে কাপল কাউন্সিলিং করাতে পারেন। আর নিজের সন্তানকে ম্যান-চাইল্ড করে তুলতে না চাইলে ছোট থেকেই সচেতন হতে হবে।
আপনিই যদি হয়ে থাকেন ম্যান-চাইল্ড
আপনি যদি বুঝতে পারেন, ম্যান-চাইল্ডের লক্ষণগুলো আপনার মধ্যে রয়েছে তবে সমস্যার অর্ধেক সমাধান এখানেই হয়ে গেছে।
ডা. মাহবুব আজাদ বলেন, এই ধরনের শিশুসুলভ আচরণের ফলে সম্পর্কে কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় তা খুঁজে বের করুন। অতঃপর নিজের আচরণে মনোযোগ দিন। ধীরে ধীরে এই ধরনের আচরণ কমিয়ে আনুন।
নিজেকে প্রকাশ করুন। আপনার কী অসুবিধা হচ্ছে, আপনি কী চান সেটা জানান। আপনার ভেতরে যেটা চলছে, সেটা জীবনসঙ্গী বা বিশ্বস্ত কাউকে খুলে বলুন। তাদের কাছে সাহায্য চান। ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ নিতে শিখুন। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পারেন।
Comments