গতানুগতিক বলতে চাই না, অন্তর্বর্তী সরকার আগের ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারেনি: আমীর খসরু
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
আগামী ৪ জুন বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেট প্রতিক্রিয়া জানাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাজেটে স্বভাবতই আমার প্রত্যাশা সীমিত। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের একটা সীমাবদ্ধতা আছে, সময়ের ব্যাপার আছে। এছাড়া একটি নির্বাচিত সরকারের বাজেটের প্রতি অ্যাপ্রোচ—যে দীর্ঘ সময় তার থাকার মেয়াদ, এই ব্যবধানগুলো তো আমাদেরকে বুঝতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, বিগত সরকার বাজেটের আকার বাড়াতে বাড়াতে যে জায়গায় নিয়ে গেছে, সেটার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, যখন রাজস্ব আয়ের পুরোটাই পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ব্যয় হয়ে যাবে, তখন পুরো উন্নয়ন বাজেটটা কিন্তু দেশের ভেতর থেকে কিংবা বাইরে থেকে ধার করে চালাতে হবে। ফলে যে সমস্যাটা হয়—সরকার যখন দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে ঋণ নেয়, সেই ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে এবং দেশের মানুষকে সেটা দিতে হয় বছরের পর বছর। এছাড়া, ঋণের ওপর সুদের কারণে উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হয়। আবার দেশের ভেতর থেকে ঋণ নিলেও যে সুদ পরিশোধ করতে হয়, সেটা দেশের সামগ্রিক বাজেটকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।'
'দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ঋণ নিলে ব্যাংকের সুদ হার বেড়ে যায় এবং সরকার ব্যাংকের থেকে যখন বেশি ঋণ নিয়ে নেয়, তখন কিন্তু ব্যক্তি খাতে ঋণের পরিমাণ কমে যায়। এতে বিনিয়োগ হয় না, ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না। মানুষের আয়ও বৃদ্ধি পায় না। বেসরকারি খাত ঋণ না পেলে দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ বাড়ে না। সুতরাং আমি মনে করি, এই বাজেটে আমাদের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে বাজেটের আকারের সম্পৃক্ততা থাকা উচিত ছিল, আমি মনে করি সেটা হয়নি' বলেন তিনি।
বিএনপির নীতি-নির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য আরও বলেন, 'রাজস্ব পুরোটাই পরিচালনা ব্যয়ের মধ্যে চলে যাবে এবং দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে ঋণ নিতে গেলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'
'আগে যেভাবে বাজেট চলে আসছে, মূলত সংখ্যার ছোটখাটো তারতম্য হয়েছে, কিন্তু বাজেটের যে প্রিন্সিপাল, ওই জায়গাটায় কিন্তু আমরা আগের মতো রয়ে গেছি। গতানুগতিক শব্দটা আমি বলতে চাই না, অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারেনি,' যোগ করেন তিনি।
বাজেটের আকার আরও ছোট হওয়া উচিত ছিল উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, 'এই বাজেট রাজস্ব আয়কে ভিত্তি করে করা উচিত ছিল। তাহলে বেসরকারি খাতে মানি ফ্লো থাকলো, তার বিনিয়োগও থাকলো এবং ইন্টারেস্ট রেটটা কমে আসতো। সুতরাং আমি মনে করি, এই মৌলিক জায়গায় গলদটা রয়ে গেছে।'
তিনি আরও মনে করেন, এই বাজেট বাস্তবায়ন আগামী দিনের সরকারের জন্য খুব একটা সহজ হবে না।
আজ সোমবার অর্থ উপদেষ্টা বাজেট প্রস্তাব করেন। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণ করেন। একইসঙ্গে তিনি স্মরণ করেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অকুতোভয় শহীদদের। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন তিনি। বলেন, '২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমাদের ওপর বর্তায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটি।'
'আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সাথে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সে লক্ষ্য পূরণে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান এর পর যে আশায় আমরা বুক বেঁধেছিলাম তা খুব শীঘ্রই আমরা পূরণ করতে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ।'
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তৃতা রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়।
১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব পাস হবে আগামী ৩০ জুন।
সর্বশেষ ২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংসদের বাইরে বাজেট দেওয়া হয়েছিল।
ওই বছরের ৯ জুন তখনকার অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ২০০৮-০৯ অর্থবছরের জন্য ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। সেদিনও ছিল সোমবার।
এবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে নিজের প্রথম বাজেট দিতে যাচ্ছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ; যিনি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সামরিক থেকে গণতান্ত্রিক বিভিন্ন সরকারে ১৫ জন অর্থমন্ত্রী বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (অর্থ উপদেষ্টা অথবা সামরিক আইন প্রশাসকসহ) ৫৩টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন।
তিন মেয়াদে সর্বোচ্চ ১২টি করে বাজেট দেওয়ার রেকর্ড আছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সরকারের দুই প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আবদুল মুহিতের।
আওয়ামী লীগের গত চার মেয়াদে সাড়ে ১৫ বছরে আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা দশবার, আ হ ম মুস্তফা কামাল পাঁচবার এবং আবুল হাসান মাহমুদ আলী একবার জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেন।
নির্বাচিত সরকারের আমলের এসব বাজেট জাতীয় সংসদেই উপস্থাপন করা হয়। পরে মাসজুড়ে সেই প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনা হত সংসদে। জুন মাসের শেষ দিকে সংসদে পাস হত নতুন অর্থবছরের বাজেট।
এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করার পর ৩০ জুন তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে।
তবে অতীতের রেওয়াজ মেনে বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া পুরো জুন মাসজুড়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
সর্বশেষ ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়ে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জুলাইয়ে নতুন অর্থবছর শুরুর পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
স্বাধীনতার পর এবার প্রথমবার বাজেটের আকার বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে কমিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার আশপাশে (জিডিপির ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ) ধরা হচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ কমছে আকার; টাকার অংকে যা সাত হাজার কোটির মতো।
Comments